অরিত্রির জন্য দুফোঁটা চোখের জল

প্রকাশ | ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:২৫

জসিম মল্লিক

টরন্টোর রাস্তায় রাত এগারোটায় বাস থেকে নেমে এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। কানে হেডফোন, পিঠে ভারী ব্যাগপ্যাক। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সেন্টজর্জ ক্যাম্পাস থেকে ফিরছে। তরুণীটি নিশ্চিন্ত, উদ্বেগহীন। কোথাও কোনো আতঙ্ক কাজ করছে না। কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এমনকি তার সাথে আই কনটাক্টও অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাতেও ক্লাস হয়। স্কুলেও তরুণীটি কখনও শিক্ষকদের ভয়ে আতঙ্কে ভোগেনি। তরুণীটির নাম অরিত্রি। অরিত্রি আমার মেয়ে।

কিন্তু ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীকে মোবাইল ফোনে নকলের অভিযোগে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। ক্ষমা চাওয়ার পরও তাকে এবং তার বাবাকে অপমান করেন প্রিন্সিপাল। তাই পনের বছরের সুন্দর মেয়েটি কষ্টে লজ্জায় ঘরে ফিরে আত্মহত্যা করে। মেয়েটির নামও অরিত্রি। খবরটা পড়ে মনটা ভেঙে গেছে আমার। এ কেমন নিষ্টুরতা! কানাডার স্কুলগুলোতো দেখেছি শিক্ষকরা যেন বন্ধু। ছাত্ররা ভুল করলে সেজন্য কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা আছে।

দুই.

কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষকরা ছাত্রদের কাছে যেন এক আতঙ্ক! ক্লাসকক্ষতো আতঙ্ক ছড়ানোর জায়গা না। স্কুলের ম্যানেজমেন্ট কমিটিও এমনই। একটা ঘটনা বলি। ১৯৭৬ সালের কথা সেটা। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি একদিন ক্লাস পরিদর্শনে এলেন। সেদিন আমি স্যান্ডেল পরে স্কুলে গিয়েছিলাম। আমার একজোড়াই জুতা ছিল। আগের দিন বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। সেদিন সভাপতি মহোদয় আমাকে কান ধরে ক্লাসকক্ষ থেকে বের দিলেন। আমি অপমানে লজ্জায় কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গেলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন কী হইছে! আমি বললাম আমার পেটব্যাথা তাই চলে আসছি। অথচ সেদিন ক্লাস শিক্ষক আমাকে বাঁচাতে পারতেন। বাঁচাননি। এটাও এক ধরনের নিষ্ঠুরতা।

তিন.

সরকারি স্কুল পর্যায়ে যারা শিক্ষকতা করেন বা শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারা শুধুই চাকরি করেন। শিক্ষার উন্নতির জন্য কিছু করেন না। তাদের কোনো ভিশন নাই। তাইত বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পৃথিবীর প্রথম পাঁচশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। এতেই বোঝা যায় আমাদের শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে আছে। আমি একজন শিক্ষা অফিসারকে চিনি, যিনি ঘুষ খেয়ে এখন বিরাট সম্পদশালী। গাড়ি বাড়ি সব আছে এখন।

চার.

শিক্ষকদের এতো নিষ্ঠুর হলে চলে না। ক্লাসকক্ষে আতঙ্ক ছড়ানো শিক্ষকদের কাজ না। দেশটার সর্বত্র শুধু আতঙ্ক! ঢাকার রাস্তায় পা দিলেই আতঙ্ক ভর করে। কখন কী ঘটবে কেউ জানে না। যেকোনো সময় ছিনতাইকারী ছুরির পোঁচ দিয়ে পেট ফেরে সব লুটে নেবে, টাকা না দিলে হিজরা গু মেখে দেবে গায়ে, কোনো কারণ ছাড়াই কোনো বাহিনী তুলে নিয়ে যাবে, গুম করে দেবে, বুড়িগঙ্গায় লাশ ভাসবে। বিচারের কোনো জায়গা নাই। মন্ত্রী আতঙ্ক, এমপি আতঙ্ক, মেম্বার আতঙ্ক, সচিবালয় আতঙ্ক, দুদক আতঙ্ক, সিইসি আতঙ্ক, কোট কাছারি আতঙ্ক! শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক! এতো আতঙ্কের মধ্যে মানুষ বাঁচে কীভাবে!

পাঁচ.

অরিত্রি মা! আমরা তোমার জন্য শুধু দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারি।

লেখক: টরন্টো প্রবাসী সাংবাদিক