ত্যাগে-রক্তে-বীরত্বে মুক্তি এসেছিল ঠাকুরগাঁওয়ে

বদরুল ইসলাম বিপ্লব, ঠাকুরগাঁও
 | প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:২৪

একাত্তরে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) ছিলেন তসলিম উদ্দীন। শখ করে নিজের বাংলোয় দুটি চিতাবাঘ পুষতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চিতাবাঘ দুটি তাদের ক্যাম্পে (বর্তমান বিডিআর ক্যাম্প) নিয়ে যায়। পরে অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিকে বাঘের খাঁচায় ফেলে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধে হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে অনেক ত্যাগে-রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে স্বাধীনতা। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বীর বাঙালির অপরিসীম বীরত্বগাথাও সমুজ্জ্বল হয়ে আছে বর্তমান জেলাটির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

মুক্তিযোদ্ধা মন্টু দাস জানান, মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে বাঘের খাঁচায় দেশের জন্য জীবন দিতে হয়েছিল। ১০ নভেম্বর গ্রেফতারের পর শত অত্যাচার সহ্য করেও সালাহউদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি পাকিস্তানি সেনাদের। ১২ নভেম্বর শুক্রবার বেলা ১১টায় মেজর জামানের নির্দেশে হাত-পা বেঁধে তাকে বাঘের খাঁচায় ছুড়ে দিয়েছিল বর্বর হানাদাররা।

মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান জানান, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নিরাপদ মুক্তাঞ্চল, যেখানে শত্রুবাহিনী কখনোই প্রবেশ করতে পারেনি। সেই মুক্তাঞ্চল থেকে ঠাকুরগাঁওয়েও পরিচালিত হয় মুক্তিবাহিনীর লড়াই।

একাত্তরের ২৭ মার্চ মহকুমায় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে প্রথম শহীদ হন রিকশাচালক মোহাম্মদ আলী। পরদিন ২৮ মার্চ ‘জয় বাংলা’ বলায় শিশু নরেশ চৌহানকেও গুলিতে হত্যা করে।

১৫ এপ্রিলের পর পুরো জেলা দখলে নিয়ে শহরের ইসলামনগর থেকে ছাত্রনেতা আহাম্মদ আলীসহ সাতজনকে ঠাকুরগাঁও ক্যাম্পে ধরে এনে আটকে রাখে পাকিস্তানি সেনারা। পরে বেয়নেট চার্জে হত্যার পর তাদের মরদেহ শহরের টাঙ্গন ব্রিজের পশ্চিম পাশে গণকবর দেয়। একইভাবে তৎকালীন এমপি ফজলুল করিমের কয়েকজন চাচাতো ভাইসহ ছয়জনকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

১৭ এপ্রিল হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ২ হাজার ৬০০ জন নারী-পুরুষ ও শিশুকে পাথরাজ নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করে। জগন্নাথপুর, গড়েয়া শুখাপনপুকর এলাকার কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষ তখন ভারতে যাচ্ছিল। স্থানীয় রাজাকাররা তাদের আটক করে মিছিলের কথা বলে পুরুষদের লাইন করে পাথরাজ নদীর তীরে নিয়ে যায়। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে তাদের।

স্বামী হারিয়ে সেদিনের বীভৎস ক্ষত নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন ৪ শতাধিক বিধবা নারী।

দ্বিতীয় গণহত্যা চালানো হয় রানীশংকৈল উপজেলার খুনিয়াদিঘির পাড়ে। মালদাইয়া বলে পরিচিত স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী হরিপুর ও রানীশংকৈল উপজেলার নিরীহ লোকজনকে ধরে নিয়ে যেত ওই পুকুরের পাড়ে। সেখানে একটি শিমুল গাছের সঙ্গে হাতে-পায়ে লোহার পেরেক গেঁথে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালাত। তারপর লাইনে দাঁড় করিয়ে সাধারণ মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হতো।

মানুষের রক্তে একসময় লাল হয়ে ওঠে ওই পুকুরের পানি। তাই এ পুকুর ‘খুনিয়াদিঘি’ নামে বলে জানান মুক্তিযোদ্ধা বাবলু।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সুবোধ চন্দ্র রায় জানান, জুলাইয়ের প্রথম দিকে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ ও সম্মুখযুদ্ধ শুরু করে মুক্তিবাহিনী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলারা হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেন, বেশ কিছু ব্রিজ-কালভার্ট উড়িয়ে দেন। দালাল রাজাকারদের বাড়ি ও ঘাঁটিতে হামলা চালান। নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তীব্র শীতের মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্মক অভিযান চালান।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতৃকার জন্য শীত-বর্ষা উপেক্ষা করে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে অবশেষে ৩ ডিসেম্বর মুক্ত করেন ঠাকুরগাঁও মহকুমাকে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :