ব্যাংকে আগ্রহ বেড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের

প্রকাশ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:২৫

রহমান আজিজ

যারা একসময় ব্যাংক লেনদেনের কথা ভাবতেই পারত না, সেসব দুস্থ আর নিম্ন আয়ের মানুষের টাকা জমেছে ব্যাংকে। রাষ্ট্রায়ত্ত আটটিসহ বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের হিসাব খোলা হয়েছে ১ কোটি ৮৮ লাখের বেশি। আর এসব হিসাবের বিপরীতে জমা হয়েছে ১ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। হিসাব খোলা ও পরিচালনায় কোনো ধরনের চার্জ না থাকায় ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় এসেছে অগণিত নিম্ন আয়ের মানুষ।

আগে ব্যাংক খাতের বড় ভোক্তা ছিল দেশের সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত লোকেরা। দুস্থ বা নিম্ন আয়ের বড় অংশই ছিল আর্থিক সেবা খাতের বাইরে। তাদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে সরকার নানা সার্কুলার জারি করে। নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থায় হিসাব খোলার কার্যক্রম। ন্যূনতম ১০ টাকা, ৫০ টাকা এবং ১০০ টাকা জমা দিয়ে এসব হিসাব খোলার সুযোগ রাখা হয়। সর্বনিম্ন জমার বাধ্যবাধকতাও তুলে দেওয়া হয়। এসব হিসাবে জমা অর্থের ওপর মুনাফার হার অন্য হিসাবের চেয়ে বেশি দিতে বলা হয়। ফলে এসব হিসাব খোলার প্রবণতা বেড়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ দশমিক ৯০ শতাংশ অতিদরিদ্র। গ্রামাঞ্চলে অতিদরিদ্র মানুষের জীবনযাপনে সহায়তা ও আপৎকালীন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এদের দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। এই শ্রেণির ২১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪ জনের ব্যাংকে সঞ্চয় ২৬৭ কোটি টাকা।

এসব হিসাবের সুবিধাভোগীদের মধ্যে কৃষক, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতাভোগী, মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষুদ্র জীবনবীমা পলিসি গ্রহীতা, অতিদরিদ্র উপকারভোগী, অতি-দরিদ্র মহিলা উপকারভোগী, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সুবিধাভোগী, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুস্থ পুনর্বাসনের অনুদানপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিক, চামড়া ও পাদুকাশিল্প-কারখানায় কর্মরত শ্রমিক, ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুস্থ’ পুনর্বাসনের অনুদানপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, স্কুলের শিক্ষার্থী, কর্মজীবী পথশিশু-কিশোর, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে অনুদানপ্রাপ্ত দুস্থ’ ব্যক্তি, আইলাদুর্গত ব্যক্তি, সব ধরনের প্রতিবন্ধীরা রয়েছে।

উল্লিখিত মানুষের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে কাজ করছে সরকারি ৮ ব্যাংক। এগুলো হচ্ছে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কৃষকের হিসাব খোলা হয়েছে ৯৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮৩৬টি। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৩টি, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি খাতে ২৫ লাখ হাজার ২৮ হাজার ১৮২টি, মুক্তিযোদ্ধা খাতে ২ লাখ ৩ হাজার ৪৪১টি, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন শ্রমিকের ৯ হাজার ৭৪৬টি, তৈরি পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকের হিসাব ২ লাখ ৭৮ হাজার ৬৬৩টি, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সুবিধাভোগীর ৪৪ হাজার ৩৬টি, এলএসবিপিসি প্রকল্পভুক্ত কারিগরের ৪ হাজার ৩১৫টি, ক্ষুদ্র জীবনবীমা পলিসি গ্রহীতার ১ লাখ ১৪ হাজার ৯২৮টি, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের ১ লাখ ৮৬ হাজার ৮৮৬টি, দুস্থ পুনর্বাসনের অনুদানভোগীদের ১ হাজার ৪২৩টি, ফুড ও লাইভলিহুড সিকিউরিটি প্রকল্পের ৬২ হাজার ৮১০টি এবং অন্যান্য খাতে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৩৭৮টি হিসাব খোলা হয়েছে। এসব হিসাবের মধ্যে বেশির ভাগ হিসাবই খোলা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৮ ব্যাংকে।

১০ টাকার অ্যাকাউন্ট খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয় কৃষকদের মাধ্যমে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৯ লাখ ৬৫ জন কৃষক এই হিসাবে জমা রেখেছেন ২৯৮ কোটি টাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে ২১৪ কোটি টাকা।

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা জমা রেখেছেন ১৩২ কোটি টাকা। প্রতিবন্ধীরা ২৩ কোটি জমা করেছেন। এ ছাড়া ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির সুবিধাভোগীদের জমা ১০৮ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র জীবনবীমা কর্মসূচি গ্রহীতারা ১৭ কোটি টাকা, এলএসবিপিসি কারিগররা ২ কোটি টাকা ২০ লাখ টাকা, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ৬০ লাখ টাকা জমা রেখেছেন।

এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দারিদ্র্য কমানো, টেকসই ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির জন্য সোনালী ব্যাংক দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিতদের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এর জন্য প্রধান কার্যালয়ে পৃথক একটি সেল গঠন করা হয়। গত বছর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কর্মসূচির আওতায় সোনালী ব্যাংকে ৫৬ লাখ ১৯ হাজার মানুষ অ্যাকাউন্ট খোলেন।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাজেটের মাধ্যমে সরকার বিধবা, বয়স্ক মানুষ, দরিদ্র মা ইত্যাদি শ্রেণির মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এনেছে। তাদের প্রদত্ত ভাতা ব্যাংক হিসাবে দেওয়া হচ্ছে। এই শ্রেণির মানুষের ব্যাংকে সঞ্চয় সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ ৩৩৯ কোটি টাকা। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৪০ লাখ ৮৮ হাজার ৯৪৩ জন ভাতাভোগী এ অর্থ জমা রেখেছেন।

রূপালী ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘আমরা এ ধরনের হিসাব খুলতে আরও নতুন নতুন উদ্যোগ নিচ্ছি। এগুলো দিয়ে অন্তত ৩ কোটি মানুষের ব্যাংকিং সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।’