প্রিয় শাকিল ভাই বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে...

ড. কাজী এরতেজা হাসান
| আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৫৭ | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৩৪

অনেক রাত করে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাসটা আমার দীর্ঘদিনের। এটা খুব ভালো করেই জানতেন আমাদের প্রিয় শাকিল ভাই। কোনো এক ভোরে শাকিল ভাইয়ের ফোন। চমকে গেলাম। এত ভোরে তো তার ঘুম ভাঙার কথা নয়। ফোন ধরতেই বললেন, এইমাত্র একটা কবিতা লিখেছি। শোনেন, এরতেজা ভাই। তারপর আবৃত্তি করে গেলেন। কবিতাটি মনে নেই। এটুকু মনে আছে, বেগম মুজিবকে নিয়ে লেখা। কবিতা শোনার পর বললাম, এত ভোরে আপনার ঘুম ভাঙলো কেন? বললেন, ভাই আমি তো ঘুমাইনি। রাত জেগে কবিতা লিখেছি। এখন ঘুমাবো। এই হলো মাহবুবুল হক শাকিল। এলোমেলো, বাউণ্ডুলে, চূড়ান্ত বোহেমিয়ান, উড়নচণ্ডি, আউলা বাউল, ঘোর লাগা, আবেগে ভেসে যাওয়া, তুমুল প্রেমিক, আপোসহীন বিপ্লবী, কবিতায় পাওয়া, প্রচণ্ড মন খারাপ করা, উন্মাতাল মন ভালো করা, জীবনকে কানায় কানায় যাপন করা একজন মানুষ।

মানুষকে স্নেহে, ভালোবাসায়, প্রেমে ভাসিয়ে দেয়ার মত এমন ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই আছে। শুধু লেখায় নয়, সামনাসামনিও তার সাথে সরকারের বিরোধিতা করা যেতো, তর্ক করা যেতো। শুধু বঙ্গবন্ধু আর বড় আপা, ছোট আপা ছাড়া। বড় আপা মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি পীর মানতেন। তিনি দলীয় পদ চাইতেন না, ক্ষমতা চাইতেন না; চাইতেন শুধু পীরের পায়ের কাছে বসে থাকার সুযোগ। শেখ হাসিনার সাথে, আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কটা সাংগঠনিক নয়, ছিল আবেগের। আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতাকে দেখেছি, প্রত্যাশিত পদ না পেলে বা কোনো কারণে নিজেকে বঞ্চিত মনে করলে দল এমনকি দলীয় সভানেত্রীর বিরুদ্ধেও অনেক কটু কথা বলতেন বা বলেন। কিন্তু শাকিল ভাইয়ের মুখে কখনো তেমন কিছু শুনিনি। সৈয়দ আশরাফ স্থানীয় সরকার মন্ত্রী থেকে বাদ পড়ার পর শাকিল ভাইয়ের শিশুর মত কান্না দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। হাইব্রিড আর ধান্দাবাজদের এই সময়ে দলের প্রতি, নেতার প্রতি এমন ভালোবাসা অবিশ্বাস্যই মনে হয়।

আটবছর ধরে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন প্রিয় শাকিল ভাই। অনেক হম্বিতম্বি করতেন। সাধারণের উপকারে ক্ষমতার ব্যবহার করতেন। কিন্তু অপব্যবহার করতে দেখিনি কখনো। সবসময় জোর গলায় বলতেন, আমার বিরুদ্ধে অনেক বদনাম করা যাবে। কিন্তু অসততা বা দুর্নীতির কোনো অভিযোগ কেউ আনতে পারবে না। আমি জানি এটা সত্যি। সংসার খরচ নিয়ে ভাবির সাথে ঝগড়া করে ফেসবুকে মজার স্ট্যাটাস দিয়েছেন। পরে ভাবিও বলেছেন, ‘বলেন তো সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু ঠিকমত সংসার খরচ দেয় না। কাহাতক সহ্য করা যায়।’ অর্থকষ্ট নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শুধু প্রেম বিরহের কষ্ট নয়, অনেক সময় অর্থকষ্টও কবিতা লিখিয়ে নিতে পারে।’ অর্থকষ্ট ছিল। কিন্তু তার সাথে আড্ডায় বসে কেউ কখনো বিল দিতে পারেনি। আড্ডা থেকে বেরুতেন পকেট খালি করে।

এত এলোমেলো জীবনযাপনের পরও কখন লিখতেন, কখন পড়তেন; আমি অবাক হয়ে ভাবি। তার পড়ার জগতও বিস্তৃত। তার বেডরুম ঠাসা ছিল বইয়ে। কোনো আড্ডায় কবিতার নেশায় পেয়ে গেলে স্মৃতি থেকে একের পর এক কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। লেখালেখির নেশায় পাওয়া এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষের এমন অকাল মৃত্যু আসলেই বেদনার্ত করে সবাইকে।

শাকিলরা আসলে এমনই। উদ্দাম জীবনের পাশে শুয়ে থাকে গভীর বিষাদ। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা লেখা শেষ কবিতায়ও লিখেছিলেন, মৃত্যুর কথা ‘মৃতদের কান্নার কোনো শব্দ থাকে না, থাকতে নেই/নেই কোনো ভাষা, কবরের কোনো ভাষা নেই/হতভাগ্য সে মরে যায় অকস্মাৎ বুকে নিয়ে স্মৃতি/তোমাদের উত্তপ্ত সৃষ্টিমুখর রাতে।’

অনেক মেধাবি এই প্রিয় মানুষটি ভোরের পাতার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন। নানা জাতীয় ইস্যুতে আমাদের বহু কথা হয়েছে। তার প্রিয় সামদাদোতেও আড্ডা বসেছে। রাতের পর রাত কথা বলেই কাটিয়েছি আমরা। সাহিত্যপ্রিয় এই মানুষটি ভোরের পাতার সাহিত্য সাময়িকী ‘চারুপাতা’ একজন উদ্যোক্তাও। এই নামটিও তারই দেয়া। একবার ফোন করে শাকিল ভাই বললেল, তামিম নামের একটা ছোট ভাইকে আপনার কাছে পাঠাচ্ছি। ওর একটা চাকরি দরকার। দেখবেন প্লিজ। তামিম আসার পর আমি দ্বিতীয়বার তার কাছে জানতে চাইনি। শাকিল ভাইয়ের কথায় তামিমের চাকরিটা হয়েছিল। এমন হাজারো মানুষের উপকার করতে ভালোবাসতেন আমাদের শাকিল ভাই।

শাকিল ভাইকে নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কথাই লিখতেই হয়। তবুও আমাদের থামতে হয়। প্রিয় শাকিল ভাই, বেঁচে থাকবেন আমাদের ‍হৃদয়ে, স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এই দোয়া করি, আমাদের সবার প্রিয় শাকিল ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন, আমিন।

লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ভোরের পাতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

গণমাধ্যম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা