চার গ্রামের বীরত্বগাথা মনে রাখেনি কেউ

সুজন সেন, শেরপুর
 | প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:০৮

মহান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে শেরপুরের তন্তর, আহমদনগর, রাঙামাটি খাটুয়ামাড়ি ও সূর্যদি গ্রাম। হত্যা-গণহত্যা, ধর্ষণসহ অবর্ণনীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়ে স্বাধীনতার বেদিতে অনেক রক্ত বিসর্জন দিয়েছেন গ্রামগুলোর লোকজন ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানসহ মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসীর বীরত্বগাথাও কম নয়।

তবে প্রায় সব ক্ষেত্রেই এসব ত্যাগ-বীরত্বের কথা কেউ মনে রাখেনি। স্বীকৃতি মেলেনি শহীদ পরিবার ও বীরাঙ্গনাদের। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্থাপনাগুলোও অবহেলায় নষ্ট হতে চলেছে।

নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া-ম-ালিয়াপাড়া ইউনিয়নের তন্তর গ্রাম ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ঘাঁটি। অন্যদিকে ঝিনাইগাতী উপজেলার আহমদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিল পাকিস্তানি বাহিনী। হানাদার ও তাদের দোসররা স্কুলটিকে নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। নালিতাবাড়ী উপজেলার ফরেস্টক্যাম্পও ছিল তাদের ঘাঁটি।

তন্তর: ৩০ জুন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলবদর-রাজাকারদের নিয়ে ওই গ্রামে হামলা চালায়। এ সময় তিনজন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ সাতজন শহীদ হন। কিন্তু গ্রামবাসীর অপরিসীম ত্যাগ ও শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেই।

আহমদনগর: একাত্তরের নয় মাসই এখানে চলে পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতা। নারী-পুরুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানোর পর তাদের বগাডুবি ব্রিজে নিয়ে অথবা কোয়ারি রোড, জুলগাঁওয়ে হত্যার পর এসব মরদেহ মাটিচাপা দিয়ে অথবা নদীতে ভাসিয়ে দিত। স্বাধীনতার পর আহমদনগর স্কুল ও তার আশপাশের এলাকায় অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যায়।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঘাগড়া কোনাপাড়া বধ্যভূমির পাশে এলজিইডির অর্থায়নে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হলেও তা অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্মৃতিস্তম্ভটি এখন গোচারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

রাঙামাটি খাটুয়ামাড়ি: শেরপুর-ঝিনাইগাতী-নালিতাবাড়ী সড়কের কাঁটাখালি ব্রিজ ছিল সীমান্ত যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। পাকিস্তানি হানাদারদের সীমান্ত এলাকায় অবাধ যাতায়াত বন্ধে তাই ব্রিজটি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিযোদ্ধারা। কিন্তু দুবারেও সফল না হওয়ায় এ ব্রিজ অপারেশনে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র নাজমুল আহসান। ৫ জুলাই রাতে তিনি তার ৫৩ জন সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাঁটাখালি ব্রিজ ও তিনানি ফেরি ধ্বংসের সফল অপারেশন শেষে ঝিনাইগাতীর রাঙামাটি-খাটুয়ামারি গ্রামে আশ্রয় নেন। পরদিন ৬ জুলাই এ গ্রামের দালাল জালাল মিস্ত্রির সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা তিনদিক পানিবেষ্টিত গ্রামটিতে হামলা চালায়। এ সময় সম্মুখযুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসান, তার চাচাতো ভাই মোফাজ্জল হোসেন ও ভাইপো আলী হোসেন শহীদ হন। আহত হন বেশ কয়েকজন।

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়ায় নয় গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা ও ছয় নারীকে ধর্ষণ করে বর্বর হানাদাররা।

সূর্যদি: চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাত্র ২১ দিন আগে শেরপুর সদর উপজেলার সূর্যদি গ্রামে ঘটে নারকীয় গণহত্যা। ২৪ নভেম্বর পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসরদের নারকীয়তার শিকার হন এক মুক্তিযোদ্ধাসহ ৬২ জন গ্রামবাসী। স্বাধীনতার পর গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে স্মৃতিফলক নির্মাণ করলেও সেটির এখন খুবই হতশ্রী অবস্থা। সংস্কার কিংবা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বহু মানুষকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় নালিতাবাড়ী ফরেস্টক্যাম্পেও। ধর্ষণ করা হয় নারীদের। স্বাধীনতার পর এখানকার কূপ থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য কঙ্কাল। কালের সাক্ষী এ ক্যাম্পটির স্মৃতিও আজ বিস্মৃত হতে চলেছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :