অরিত্রীর শাস্তি তাহলে কী হতে পারত?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৫৭

মাঝে মাঝে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নেতিবাচক দিকটা মর্মান্তিকভাবে প্রকাশিত হয়। জীবন এতই ঠুনকো আর মূল্যবোধহীন হয়ে গেছে যে, দেশের সেরা স্কুলের একটি মেয়ে পড়ালেখাসংক্রান্ত একটা ঘটনায় নিজেকে হত্যা করতেও পিছপা হলো না। বাবা-মায়ের ভালোবাসা, হেমন্তের নীল আকাশ, রাতের তারা, সকালের কুয়াশা, শিশির কনা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন কিংবা মাশরাফি বাহিনীর বীরোচিত ক্রিকেট যুদ্ধ, কিছুই অরিত্রী নামের মেয়েটিকে রুখতে পারেনি। সে আত্মহত্যা করে সমস্ত ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে। অরিত্রী কি মুক্তি পেয়েছে? তবে অরিত্রী তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন করে গেছে।

ভিকারুন্নিসা নুন স্কুলের নিয়ম আছে, ছাত্রীরা মোবাইল নিয়ে ঢুকতে পারবে না। অরিত্রীও এ নিয়ম মেনে চলত। সেদিন হঠাৎ করে কী এমন প্রয়োজন পড়ল যে অরিত্রী মোবাইল ফোন নিয়ে পরীক্ষার হলে প্রবেশ করল? ক্লাস নাইনের একজন পরীক্ষার্থী পরীক্ষার হল পর্যন্ত মোবাইল ফোন নিয়ে আসবে কেন? অরিত্রীর বয়স কত? দেশে নিশ্চয় মোবাইল ফোন ব্যবহারের আইন-কানুন আছে। কত বছর বয়স হলে একজন ছেলে/মেয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহারের যোগ্য হয়? আশা করি সবাই জেনে নেবেন এর উত্তর। অরিত্রীকে এই মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিল কারা? অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন শিক্ষার্থীকে মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে কি তার বাবা/মা সঠিক কাজ করেছিলেন? অরিত্রীকে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়ার পর থেকে বাসায় যাওয়া এবং আত্মহত্যা করার আগ পর্যন্ত তার বাবা-মা কি তার সাথে যথাযথ আচরণ করেছিল? অরিত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে চললে হবে না। আরও অরিত্রী যেন এভাবে অকালে নিজেকে শেষ করে না দেয় সে জন্য এসব প্রশ্ন উত্থাপন ও এসবের উত্তর খোঁজা অতীব জরুরি।

বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পিএসসির কোনো পরীক্ষায়ও কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন পাওয়া গেলে সেই ছাত্র-ছাত্রীকে ‘শাস্তি’ পেতেই হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ছাত্র-ছাত্রী সাধারণ অপরাধ করলে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়ম কানুন মেনে ব্যবস্থা নেয়া যায়। বড় ধরনের ফৌজদারি অপরাধ হলে রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনেই বিচার হয়। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। ব্যবস্থা নেয়ার সময় নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করতে হয়। অরিত্রী যত মেধাবীই হোক না কেন, পরীক্ষার হলে সে মোবাইল ফোন আনতে পারে না। ক্লাস নাইনের একটা মেয়ে ভুল করে হলে মোবাইল ফোন নিয়ে আসবে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেখানে মোবাইল ফোন আনাই নিষেধ, সেখানে সে মোবাইলে নকল ছিল কি না, এ প্রশ্ন বাহুল্য।

পরীক্ষার হলের ভেতরে অরিত্রীর কাছ থেকে মোবাইল ফোন জব্দ করার পর স্বাভাবিকভাবেই তার অভিভাবককে ডেকে আনা উচিত ছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাই করেছে। অরিত্রীকে ফোন কিনে দিয়েছিল নিশ্চয় তার বাবা অথবা মা। অরিত্রী নিশ্চয় স্কুলে একা আসেনি। প্রতিদিনের মতোই তার বাবা/মা বা অন্য কেউ তাকে স্কুলে নিয়ে এসেছিল। অরিত্রীর ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থাকলেও সেটি অভিভাবক কারও কাছে বাইরে আসতে পারত। যদি অরিত্রী একাও এসে থাকে, গাড়িতে কিংবা গাড়ি না থাকলে ক্লাসমেটের অভিভাবকের কাছে ফোন রেখে আসতে পারত। পরীক্ষার হলে প্রবেশের আগে স্কুল কর্তৃপক্ষও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখতে পারে। এগুলোর কিছুই ঘটেনি সেদিন। অরিত্রী পরীক্ষার হলেই মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছে। শিক্ষক ধরতে পেরে ব্যবস্থা নিয়েছেন।

পরীক্ষার হলে অবৈধ কোনো কিছু নিয়ে ধরা পড়লে ব্যবস্থা নিতেই হবে। কিন্তু সমস্ত শিক্ষক সমাজের মনে প্রশ্ন জেগেছে, কী হতে পারে সেই ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীরা নকল করবে কিংবা পরীক্ষার হলে মোবাইল ফোন নিয়ে চলে আসবে আর দায়িত্বরত শিক্ষকরা কোনো ব্যবস্থা নেবেন না, এমনটা কি হতে পারে? যদি তাই না হয়, তাহলে শিক্ষকরা কী করবেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বেলায় সাধারণত বাবা-মাকে ডাকা হয় না। কিন্তু কেউ যদি চরম মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, আত্মহত্যা করতে গিয়ে ধরা পড়ে, একের পর এক অপরাধ করে বেড়ায়, অবশ্যই তার বাবা-মাকে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও ডাকা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে যারা পড়াশোনা করবে এদের এটা মেনেই করতে হবে। এই সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও বন্ধনই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর ৩০-৪০,০০০ মানুষ নিজেদের পরিচিতজন, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের গুলিতে মারা যায়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঝে মাঝেই বন্দুক নিয়ে সহপাঠী ও শিক্ষকদের হত্যা করে।

আমরা কি তবে এমন সমাজই চাচ্ছি, যেখানে সবাই নিজেকে আলাদা ভাববে, সবাই নিজেকে স্বাধীন ভাববে? আমরা কি এমন সমাজ চাইছি, আইন অনুযায়ী প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে যেখানে ছেলে-মেয়েদের নিজেদের হালতে ছেড়ে দেয়া হয়। ছেলে-মেয়েরা কঠিন বাস্তবতায় চরম একাকীত্ব নিয়ে বড় হয়। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের কাজ নিজেরা করে, নিজের ইনকাম দিয়ে চলে। স্বাধীনতা ভোগ করতে গিয়ে পরিবার, বন্ধন, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে যৌনতা আর মাদকে শান্তি খুঁজে! তথাকথিত উন্নত বিশ্বের মানুষ পরিবার-পরিজন হারিয়ে এক পর্যায়ে পোষা কুকুর আর বিড়ালের সান্নিধ্যে একাকীত্ব দূর করে।

আমরা কি এমন সমাজ চাইছি যেখানে টিনএজ মাদার এবং গর্ভপাতের সংখ্যা অনেক বেশি? যদি না চাই, তাহলে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। ডিসিপ্লিন ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি উন্নতি করতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। স্বাধীনতা আর ডিসিপ্লিন এর কথা এজন্য বললাম যে, অনেক শিক্ষার্থী চায় যে তাদের বাবা-মাকে যেন কিছু না জানানো হয়। বাবা-মাকে একটা পর্যায়ে জানাতেই হয়। তবে কিছু হলেই অভিভাবককে ডেকে আনার কোনো যুক্তি নেই। অভিভাবকদের যদি সব কিছুতেই ডাকতে হয় তাহলে শিক্ষকরা আছেন কী জন্য?

অরিত্রীর বাবা-মাকে ডেকে স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনো ভুল করেনি। অরিত্রীর বাবা-মাকে যদি ভয়ানকভাবে অপমান করা হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। অরিত্রীকেও যদি তার বাবা-মার সামনে অপমান, অপদস্থ করা হয়ে থাকে সেটিও ঠিক হয়নি। সংকটের মুহূর্তে ব্যবস্থাপনা জানতে হবে শিক্ষকদের। বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের বেশি প্রশংসাও করা যাবে না, আবার বেশি মাত্রায় বকাঝকাও করা যাবে না। সেদিন আসলে কী হয়েছিল, সেটি আমরা শুধু গণমাধ্যমের বরাত দিয়েই কিছুটা জানতে পেরেছি। একটা ভিডিও ফুটেজ দেখা যাচ্ছে টিভিতে। সেই ভিডিওতে বাবা-মাকে অপমান করা হয়েছে এমন কিছু বোঝা যায়নি। গোয়েন্দারা হয়ত আরও বেশি কিছু জানেন। যদি বিশেষ কোনো ভিডিও থাকে যেখানে অরিত্রীর বাবা-মাকে অপমান করা হচ্ছে এমন দৃশ্য আছে সেগুলো ফেসবুকে দিয়ে দেওয়া দরকার। না হলে অনেক প্রশ্ন উত্তর খুঁজে পাবে না।

স্কুল থেকে বের হয়ে আসার পর বাসায় যাওয়া পর্যন্ত অরিত্রীর বাবা-মা তার সাথে কী রকম আচরণ করেছিলেন? এটি জানার আর কোনো উপায় নেই। তবে আমরা অনুমান করতে পারি। ছেলে-মেয়েকে যেনতেনভাবে এ প্লাস পাওয়ার জন্য সারাক্ষণ প্রেশারে রাখে কে? শুধু এ প্লাস পেলেই জীবনে সফল, আর না হলে ব্যর্থ এই মূল্যবোধ, এই প্রেশার কে কারা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত? বাবা/মায়েরা নিজেদের রেজাল্ট এর দিকে কখনো তাকিয়েছেন? নিজেরা ছাত্রজীবনে কী রেজাল্ট করতেন সেদিকে একটু তাকান। পড়াশোনা করেই বড় হতে হবে, এটা ঠিক আছে। কিন্তু পড়াশোনার পাশাপাশি শরীর, মন ভালো রাখতে হয়, এটা কি আপনারা অনুধাবন করেছেন কখনো? পাঠ্য বই পড়ার পাশাপাশি গল্প-উপন্যাস, কবিতার বই পড়তে হয়, মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করতে হয়, ঘুরতে যেতে হয়। এগুলো পুরো বিশ্বে স্বীকৃত। আমরাই চলেছি উল্টো পথে।

আচ্ছা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে পরীক্ষার্থীদের কাছে চলে যেত কীভাবে? জালিয়াত শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মাঝে ব্রিজ হয়ে কাজ করতেন দুর্নীতিপ্রিয় অভিভাবকরাই। আর আজ সব দোষ দেয়া হচ্ছে শিক্ষকদর। দায় সবাইকেই নিতে হবে। অরিত্রীর মতো সুন্দর, ফুটফুটে, সম্ভাবনাময় মেয়ে কেন আত্মহত্যার পথে যাবে? কেন সে পরীক্ষার হলে মোবাইল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করবে? রাষ্ট্রের কি কোনো দায় আছে এই বাস্তবতায়? শিক্ষাব্যবস্থার গলদ দূর করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রেরই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :