আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও কিছু কথা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
 | প্রকাশিত : ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১২:৩৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় পার করছি আমরা। ভোটগ্রহণ হবে ৩০ ডিসেম্বর। এই দিন ‘পর্যবেক্ষক মিশন’ পাঠাবে না ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। নির্বাচন কমিশনকে দুই দফায় এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে ইইউ। তবে দুই সদস্যের একটি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে পাঠাতে সম্মত হয়েছে তারা। ওই দলটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সব কর্তৃপক্ষ, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, সুশীল সমাজসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করবে।

‘আঞ্চলিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সফলতা দেখিয়েছেন। দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে ভারত বরাবর শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত বিকাশমান বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতার সুযোগ চীনও হাতছাড়া করতে চাইছে না।’

বাংলাদেশে অবস্থানকালে রাজনৈতিক পরিবেশ এবং নির্বাচনের প্রস্তুতির সার্বিক বিষয় নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করবেন। এর আগে নির্বাচন কমিশন ইইউকে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করেছিল। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কোনো পর্যবেক্ষক টিম পাঠায়নি ইইউ।

ওই সময়ে ইইউর একটি নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে এসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচনের আগেই চলে গিয়েছিল। তবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইইউর শতাধিক পর্যবেক্ষক বাংলাদেশে এসেছিলেন।

বাংলাদেশে যতবার নির্বাচন হবে ততবারই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসবে। বাংলাদেশের সদা অস্থির, সদা বিভক্ত রাজনীতির দৃষ্টান্ত এই নির্বাচন। কত কী ঘটেছিল তা হিসাব করতে গেলে পাতার পর পাতা লেখা যাবে। সরকার বদ্ধপরিকর ছিল নির্বাচন করবে আর যেকোনো উপায়ে নির্বাচন প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞায় ছিল বিএনপি-জামায়াত ও তাদের মিত্ররা। শত শত স্কুলঘর পুড়েছে যেগুলো নির্বাচন কেন্দ্র ছিল, মানুষ আগুনে পুড়েছে, পুলিশ সদস্য জীবন দিয়েছে।

সংবিধান রক্ষার সেই নির্বাচন করে পাঁচ বছর পূর্ণ করেছেন শেখ হাসিনা। তবে এই পথ পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না। মাসের পর মাস আগুন সন্ত্রাস, হিংসার রাজনীতির বলি হয়ে মানুষের কয়লা হয়ে যাওয়া দেখতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করেছেন শক্ত হাতে। বাংলাদেশ আগুন সন্ত্রাসকে পরাজিত করেছে। কিন্তু বিতাড়িত করতে পারেনি।

অনেকেরই প্রত্যাশা বাংলাদেশ আর আগুন সন্ত্রাস বা গ্রেনেড হামলার যুগে ফিরে যাবে না। কিন্তু পাঁচটি বছর পেরিয়ে আবার যখন ভোটের দ্বারে বাংলাদেশ তখন অন্য প্রত্যাশাও চলে আসে যে, সব দলের অংশগ্রহণে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হোক। নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্যতা বা আস্থার যে সংকট তা রাজনীতিকদের নিজেদের সৃষ্টি করা। বিএনপির দাবি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ফল নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্যই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান বাতিল করে দেয় এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগের পাল্টা যুক্তি, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে এটি করতে হয়েছে, সংবিধান ও উচ্চ আদালতের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের মতো সমাজে নির্বাচন মানে শুধু ভোটের অনুশীলন নয়। এখানকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে যে কত সহিংসতা মোকাবেলা করতে হয়েছে তা পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়ককে করতে হয়নি। তাই পশ্চিমা ধাঁচের বা নিদেনপক্ষে ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও এমন নজির নেই।

এই বিচার ঠেকাতে বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামী আরেক একাত্তরের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে। কিন্তু ভয়, ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে এই বিচার বন্ধ হয় কি না কিংবা এই বিচার করার কারণে নতুন কোনো সহিংস প্রেক্ষাপট তৈরি হয় কি না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা, সেই হত্যাকারীদের বিএনপি কর্তৃক পুরস্কৃত করা, আবার ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে একের পর এক গ্রেনেড হামলা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টার কারণে এখন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ শত্রুতার অবস্থানে চলে গেছে। শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন তাকে হত্যা করতে খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের পরিকল্পনায় ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট তার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা কোনোদিন আর এই গ্রেনেড হামলার কথা ভুলতে পারবে না। হামলার পর জজ মিয়া নাটক করে সরকারি প্রচেষ্টায় বিচারকে প্রহসনে পরিণত করার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা এই ধারণাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে যে, এটি ছিল সরকারি মদদে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

একদিকে দুই দলের এমন বিরোধপূর্ণ অবস্থান, অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের আঁতাত বৈরিতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এক যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেই সহিংস অবস্থা না থাকলেও দুই দলের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি বেশ প্রবল।

নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বিএনপি নির্বাচন বর্জন থেকে সরে এসে দেশে নির্বাচনী উৎসব জাগিয়ে তুলেছে। এজন্য ড. কামাল হোসেনদের ধন্যবাদ দিতে হয় যে, তারা বিএনপিকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। তবে ড. কামাল হোসেনসহ নাগরিক সমাজের যেসব রাজনীতিক বিএনপির সঙ্গে গিয়েছেন তাদের ভাবনায় আসা উচিত ছিল নির্বাচনের মুখে তারা জামায়াতকে অক্সিজেন দিচ্ছেন কি না। যা হোক সে আরেক বিতর্ক।

আঞ্চলিক রাজনীতিতে শেখ হাসিনা সফলতা দেখিয়েছেন। দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে ভারত বরাবর শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বাংলাদেশের সঙ্গে দ্রুত বিকাশমান বাণিজ্যিক ও সামরিক সহযোগিতার সুযোগ চীনও হাতছাড়া করতে চাইছে না। শেখ হাসিনার প্রতি দিল্লির অভিনন্দনবার্তার পর বেইজিংও তাই দ্রুত তাকে অনুসরণ করে। যদিও ঐতিহ্যগতভাবে চীন বিএনপির মিত্র। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়।

এদিকে গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠা মৌলবাদী দলগুলোকে থামাতে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কংগ্রেসের এ সংক্রান্ত এক প্রস্তাবে মৌলবাদী দলগুলোকে দেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ওপর হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাঙ্কস।

এতে তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে নির্বাচন কমিশনের অনুরোধে সাড়া দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর পুনরাবৃত্তিমূলক হামলা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি এবং জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর দ্বারা সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ ক্ষুণœ করে।

বলা হয়, বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসপন্থী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। এতে উল্লেখ করা হয়, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং অন্যান্য চরমপন্থী দল বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সহিংসতার গুরুতর ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রস্তাবে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, হেফাজতে ইসলামসহ যেসব মৌলবাদী দল দেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিস্বরূপ তাদের থামাতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, তারাও যেন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব অংশীদারিত্ব ও অর্থায়ন বন্ধ করে।

এগুলো সবই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা। বাংলাদেশ এসব কিছু মোকাবেলা করেই উন্নয়নের পথে হাঁটছে। নির্বাচনের মাধ্যমে বিকাশের পথে ধাবমান দেশটি যেন থমকে না যায় সেটিই মানুষের প্রত্যাশা।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :