রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী হাবিবুর রহমান

প্রকাশ | ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:০৩

কাজী রফিক

১৯৭১ সালের জাতির ক্রান্তিকালে যারা জীবনের মায়া ছেড়ে দেশের জন্য লড়েছেন তাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা গাজী হাবিবুর রহমান হাবিব। মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা মানুষটি ৪৭ বছর পরেও মনে রেখেছেন সেই দিনগুলোর কথা, সহযোদ্ধাদের কথা।

‘সেদিনগুলো কোনো সাধারণ দিন ছিল না। নয় মাসের একেকটা দিন ছিল রক্তভেজা, স্বজন হারানোর আহাজারির। তাই তা ভুলে যাওয়া অসম্ভব’ বলে মনে করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার এই অংশীদার।

ঢাকা টাইমসকে গাজী হাবিব বলেন, ‘একাত্তরে গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরে থাকতাম। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর নির্বিচারে গণহত্যা করে। সেই গণহত্যার দৃশ্য আমি নিজ চোখে দেখেছি। এতে নিজের মধ্যে ক্ষোভ জন্ম নেয়। বাড়ি থেকে বগুড়ায় আসি। সেখানে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রতিরোধে আমি ছিলাম। তবে সেখানে পাকিস্তানিদের অস্ত্র মুখে আমরা টিকে থাকতে পারিনি। বাধ্য হয়ে সেখান থেকে আমাদের পিছু হটতে হয়েছিল।’

শরণার্থীদের সঙ্গে ভারতে চলে যান হাবিব। দুই ধাপে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরেন রণাঙ্গনে। তিনি বলেন, ‘এপ্রিল মাসের শেষের দিকে একটি হিন্দু শরণার্থী দল ভারতে যায়, তখন তাদের  সঙ্গে ভারতে চলে যাই। কচুয়াডাঙ্গা ইয়ুথ ক্যাম্পে আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ইয়ুথ ক্যাম্পটির দায়িত্বে ছিলেন আমাদের এমপি আহমেদ তফিজ উদ্দিন। সেখান থেকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের পাঠানো হয় শিলিগুড়ি পানিঘাটায়। পশ্চিম দিনাজপুরের ওই ক্যাম্পে আমরা ট্রেনিং পাই।’

‘এরপর সর্বপ্রথম আমি জুন-জুলাই মাসে আর্মিদের সঙ্গে ভলেন্টিয়ার হিসেবে বালুরঘাট থেকে বের হয়ে জয়পুরহাট জেলার হিলিতে আসি। সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। সেখানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। কিন্তু পাকিস্তানিদের অস্ত্রের মুখে এবং গোলাবারুদের কাছে আমরা টিকতে না পেরে সেখান থেকে পালিয়ে যাই। এরপরে আমাদের নতুন করে সংগঠিত করেন কমান্ডাররা। গ্রুপ করে পাঠানো হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। অনেক জেলায়ই যুদ্ধ করেছি।’

সবচেয়ে স্মরণীয় যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে হাবিবের মনে পড়ে যায়, শৌচাগারের পাইপের ভেতর দিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণের কথা। তিনি বলেন,  আমাদের কাছে তথ্য আসে, কুষ্টিয়ার তালবাড়ি ঘাট এলাকায় চেয়ারম্যানের বাড়িতে মানুষকে ধরে নিয়ে রাখত, অত্যাচার-নির্যাতন করত এবং অন্যদের বাড়িতে আগুন দিত। এ যুদ্ধে আমাদের কমান্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হোসেন ও মকবুল হোসেন সান্টু। তারা আমাদের একত্রিত করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।’

‘বাড়িটির একদিকে রাস্তা ছিল, অন্যদিকে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল না। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আগে থেকেই বাড়ির ওপর থেকে এবং বিভিন্ন জায়গায় বাঙ্কার বানিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সেখানে ঢুকতে পারিনি। তারা এলএমজি ও ভারী ভারী অস্ত্র সেট করে রেখেছিল। আমাদের তো ঢুকতে হবে, বাঙ্কার তৈরি করতে হবে, পজিশন নিতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো পরিস্থিতি সেখানে ছিল না। পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা খাল পার হয়ে যাব।’

‘বাড়িটির স্যুয়ারেজ লাইনের একটা পাইপ খালে ঢুকেছে। আমি ভালো গ্রেনেড চার্জ করতে পারতাম। তাই আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল। আমি সেই বাথরুমের পাইপ দিয়ে ঢুকলাম। হাতে স্টেনগান।’

‘দৃশ্যটা এখনো মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে। বাথরুমের পাইপ দিয়ে আমাকে ঢুকতে হয়েছিল আর সেই পাইপের মধ্যে ছিল পোকা। বাথরুমের পানিতে যে পোকা তৈরি হয় সেই পোকাগুলো। সেগুলো হাতে, পায়ে, সারা গায়ে এমনকি নাক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল। তার মধ্যে দিয়েই বাড়ির নিচে গেলাম। প্রথমে আমি একটা গ্রেনেড চার্জ করলাম। শব্দ পেয়ে তার গুলি শুরু করল। কিন্তু আমরা ততক্ষণে বাড়িটির নিচে চলে এসেছি। গুলি আমাদের দিকে আসছিল না।’

‘তারা বুঝতে পারেনি যে, আমরা কোন দিকে। এরপর আমি টানা গ্রেনেড চার্জ আর গুলি করতে থাকি। অন্যরাও গুলি করেন। আমাদের এলএমজির দায়িত্বে থাকা সহযোদ্ধা এলএমজি দিয়ে গুলি করছিলেন। দুই দিন এক রাত বাড়িটি ঘিরে যুদ্ধ চলে।’

তিনি বলেন, ‘কমান্ডার যারা ছিলেন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, আমরা একটা পাশ ছেড়ে তিন দিক দিয়ে আক্রমণ করব। তাহলে তারা বের হয়ে আসবে এবং পালানোর চেষ্টা করবে। তিন দিক দিয়ে আক্রমণ তারাও একদিক থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করল। যখন তারা পালিয়ে যাচ্ছিল তখন গ্রামবাসী তাদের ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমাদের হাতে ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা মারা গিয়েছিল।’

‘সেই শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তাকে আমরা জীবিত গ্রেপ্তার করি। তার পরিবারের সদস্য, অনেক রাজাকার ছিল তাদেরও আমরা আটক করেছিলাম।’

চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যু দেখেছেন এই মুক্তিযোদ্ধা। কখনো বা সহযোদ্ধার মরদেহ ফেলেই চলে আসতে হয়েছে। যাদের সঙ্গে হাত হাত মিলিয়ে দেশ শত্রুমুক্ত করেছেন, তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমার সাথের আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্তার, নুরু, দুলাল ও জাকির। সবাই আমার সঙ্গে ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। হিলিতে আমরা দুজনের মরদেহ নিয়ে আসতে পারিনি, ওখানে রেখে চলে আসতে হয়েছিল।’

রণাঙ্গন থেকে ফিরে সাংবাদিকতায় যোগ দেন গাজী হাবিবুর রহমান। দৈনিক ইত্তেফাকসহ গোটা চারেক পত্রিকায় সাংবাদিক হিসবে কাজ করার পরে ১৯৮০ সালের পর নিজেই একটি প্রিন্টিং প্রেস শুরু করেন। এখনো প্রেস পরিচালনা করছেন জাতির এই অকুতোভয় সূর্যসন্তান।