একাত্তরের পরের কথা

মোহাম্মদ জমির
| আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:৩০ | প্রকাশিত : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৩:২৬

আমাদের স্বাধীনতা এসেছে ধাপে ধাপে। দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন, সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ছাব্বিশ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাÑ এভাবে মুক্তিসংগ্রামের পথরেখা তৈরি হয়েছে। অনেক রক্ত, অনেক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর আমরা চ‚ড়ান্ত বিজয় লাভ করি। তখনো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানে কারাবন্দি। বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাঙালি জাতির মুক্তির আকাক্সক্ষা পূর্ণতা লাভ করে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পরিচালনা করা বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য ছিল কঠিন এক লড়াই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি হানাদাররা আসলে পুরো বাংলাদেশকে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত করেছিল। প্রায় সব ধরনের অবকাঠামো ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। এ পরিস্থিতির মধ্যে কাজ শুরু করে বঙ্গবন্ধু সরকার। সেই সময়ে আমি লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসি। এখানে উল্লেখ করতে হয়, একাত্তরে আমি লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় জানুয়ারির শেষ দিকে যোগ দেই নব্য যাত্রা করা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

জুলাইয়ের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় বাহাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর তথা প্রথম বিজয় দিবসে ইংরেজি ও বাংলায় স্যুভেনির প্রকাশ করা হবে। এটাই ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রথম পদক্ষেপ, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালের বাংলাদেশকে তুলে ধরা হবে। আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত এই নতুন রাষ্ট্র কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবে, কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, তা-ও থাকবে স্যুভেনিরের মধ্যে।

এর জন্য বঙ্গবন্ধু একটি সম্পাদনা পরিষদ গঠন করেন। যার প্রধান ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। এতে আরও যুক্ত ছিলেন কেজি মুস্তাফা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল এই কমিটিতে থাকার। স্যুভেনিরের নকশা ও অলঙ্করণ সাব-কমিটির প্রধান ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। এতে আরও ছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী কালাম মাহমুদ, কাইয়ুম চৌধুরী ও রফিকুননবী।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এই স্যুভেনিরে এমন সব লেখা থাকবে, যাতে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের বিভিন্ন দিক উঠে আসবে। এতে ৯টি লেখা ছিল। আর ছিল একটি সারণি। যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে।

এতে যারা লিখেছিলেন, তারা হচ্ছেনÑ ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, ডিপি ধর (ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টা), সরদার ফজলুল করিম, বিকে জাহাঙ্গীর, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারি, কেজি মুস্তাফা। এই গুণী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আমার একটি লেখাও প্রকাশিত হয়েছিল।

সম্পাদক পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ‘বাংলাদেশ’ শিরোনামে এই প্রকাশনা বাহাত্তরের নভেম্বরের শুরুর দিকে প্রস্তুত করে ফেলতে হবে। যাতে প্রথম বিজয় দিবসের আগেই দেশের ভিনদেশি দূতাবাস ও বিদেশে বন্ধু-রাষ্ট্রগুলোর কাছে পৌঁছানো যায়। নতুন নতুন দেশে যাত্রা করা বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোয়ও এটি পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত হয়। যাতে বিদেশে বাংলাদেশের পরিচিতি তুলে ধরা যায় সহজেই। বিদেশি গণমাধ্যমগুলোর কাছেও স্যুভেনিরটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ তারা বিধ্বস্ত একটি নবীন রাষ্ট্র কীভাবে ওঠে দাঁড়াবে, তার রূপরেখা বুঝতে চেষ্টা করছিল।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা নিয়েই সম্পাদনা পরিষদ আমাকে যে লেখা রচনার দায়িত্ব দেয়, তার শিরোনামÑ ‘রিকনস্ট্রাকশন অব বাংলাদেশ।’ এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এক লেখা। কারণ ৯ মাস পাকিবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, গণহত্যা পাড়ি দিতে হয়েছে এই দেশকে। রাষ্ট্রের মৌলিক অবকাঠামো, রেকর্ড, পরিকাঠামোÑ সব কিছুই মারাত্মক ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। তাই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা দুরূহ একটি ব্যাপার ছিল।

এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় আমার রচনায় তুলে ধরেছিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধের প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরেছিলাম। স্বাধীনতা সুরক্ষা ও তার সুফল জনগণের দুয়ারে পৌঁছে দিতে করণীয় কী, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশ তার বিবরণ তুলে ধরেছিলাম। যাত্রার কয়েক মাসের মধ্যেই আসলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। সংকট উত্তরণে বঙ্গবন্ধু সরকার দারুণ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে আশ্রয় নেওয়া ১ কোটি শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাই কমিশনের (ইউএনএইচসিআর) পরিসংখ্যান মতে, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ৬ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন শরণার্থী ছিল। আর ৩ দশমিক ১৩ মিলিয়ন শরণার্থী প্রতিবেশী দেশের আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের ফেরাতে বঙ্গবন্ধু সরকারকে একদিকে পরিবহন সেবা নিশ্চিত করতে হয়েছে, অন্যদিকে তাদের ত্রাণ সহায়তাও দিতে হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট দ্রæত মেরামত ও নির্মাণে নামতে হয়। কারণ জনসাধারণের যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকলে কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব কিছুতে ধস নামার শঙ্কা থাকে। কৃষি, শিল্প-কারখানা তো বটেই, এমনকি গৃহস্থালি কাজের উপাদান-উপকরণের চাহিদা মেটাতে আলাদা করে উদ্যোগ নিতে হয় সেই সরকারকে। খাদ্য ঘাটতি, বস্ত্রের চাহিদা মেটানো ছিল তাদের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। কারণ পাকিস্তান সরকার আমাদের অর্থনীতিকে সব সময় পর্যুদস্ত করে রেখেছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ তৎকালীন অর্থ মূল্যমান অনুযায়ী ১ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। প্রাণহানি, ধর্ষণ, গণহত্যাÑ শারীরিক, মানসিক সব ক্ষতি হিসাবে ধরলে এই অঙ্ক আরও বেড়ে যাবে। এই অবস্থায় তখনকার সরকার যাদের ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সহায়তা করেছে তার মধ্যে আছেÑ কৃষক, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমার। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক উভয় গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের দায়-দায়িত্বও সরকারকে নিতে হয়েছে। এতিম ও নির্যাতিত নারীদের বাড়িঘর করে দিয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে এই সেবা পুনরায় নিশ্চিত করতে কাজ করতে হয়েছে।

মহামারি প্রতিরোধে গ্রামাঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিতে বঙ্গবন্ধু সরকারকে তখন আলাদা করে নজর দিতে হয়েছে। এসব কাজের জন্য সরকারকে ১৯৭২ সালের জুন মাসের মধ্যে ১০৭ দশমিক ৩১ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হয়েছে। এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম ধাপের কাজ।

নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় জুন মাসের শেষে। যার সূচনালগ্ন আসলে নতুন অর্থবছর। তখন কিন্তু শরণার্থীদের দেশে ফেরার গতি আরও বেড়েছে। ফলে নতুন জাতীয় বাজেটে তাদের পুনর্বাসনের বিষয়টিতে আরও জোর দিতে হয়েছে। এর জন্য বাড়িঘর নির্মাণ, পুনর্বাসন ও যুদ্ধে নিঃস্ব জনতাকে আর্থিক সহায়তা করতে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে পরিবহন, জ্বালানি ও শিল্প খাত প্রভ‚ত ক্ষতির শিকার হয়। এই ক্ষতি মিটিয়ে আবার এগুলোকে সচল করতে অনেক কর্মসূচি নিতে হয় সরকারকে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, শুধু পরিবহন খাত (সড়ক, রেল, বেসামরিক বিমান ও অভ্যন্তরীণ নৌযান এবং বন্দর) মুক্তিযুদ্ধে ১২২ দশমিক ৬৫ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়। এই ক্ষতি পূরণে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্জন ছিল এক কথায় অসাধারণ।

এখানে উল্লেখ করতে হয়, আমরা যে স্যুভেনির করেছিলাম তাতে মুক্তিযুদ্ধে ভগ্নপ্রাপ্ত অচল হয়ে যাওয়া হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ছবি দেওয়া হয়। আবার আরেক ছবি দেওয়া হয়, যেখানে ভারতীয় প্রকৌশলীদের সহায়তায় এটি সংস্কার করা হয়েছে। এটি আসলে দ্রæতগতিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্র্নির্মাণের প্রতীকী চিত্র হিসেবে দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু সরকার বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে দ্রæত বিদ্যুৎসেবা আবার ফিরিয়ে আনে। ঈশ্বরদী, উলন ও খিলগাঁও সাবস্টেশন মেরামত করা হয়। দ্রæতই সিদ্ধিরগঞ্জ, ভেড়ামারা, রূপগঞ্জ, দিনাজপুর ও মেহেরপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল হয় এবং এগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ যোগ হয়।

কৃষি খাতের প্রসঙ্গ নিয়ে বলি। আন্তর্জাতিক সংস্থার পরামর্শমতে, বঙ্গবন্ধু সরকার পরিস্থিতি উন্নয়নে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক জোগানে মনোযোগ দেয়। কৃষকরা যাতে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমপি সার ব্যবহারে উৎসাহী হয় তার জন্য উদ্যোগ নেয় সরকার। এই সময়ে উন্নতমানের বীজ ও বালাইনাশক আমদানি করা হয়। প্রায় ২৪ হাজার টন ইরি-২০ ও ৮০০ টন ইরি-৮ এর বীজ আনা হয় জরুরি ভিত্তিতে। এগুলো কৃষকের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

এ কারণে ১৯৭২ সালে খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা যতটা ছিল, বাস্তবে তা অনেকটাই প্রতিরোধ করা গেছে। বঙ্গবন্ধু সরকার বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র সব ধরনের শিল্প খাতের সমন্বয় সাধন করতে সক্ষম হয়। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি দ্রæতই ইতিবাচক পথে যেতে থাকে। পৃথিবীর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ধ্বংসস্ত‚পের মধ্য থেকে সরকার পরিচালনা, দেশ গঠনের ইতিহাস বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু সরকার অনেক ভালো করেছে।

একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর সমালোচনাকারী মহল অবশ্য বারবার ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গটি টেনে আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে চায়। কিন্তু যারা খোঁজখবর নেন গভীর থেকে, গবেষণা করেন তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে, তারা জানেন সেই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী কারণগুলো আসলে বাংলাদেশ সরকারের আয়ত্তের বাইরে ছিল, যা কিছুকাল পরেই জানা যায়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত আমেরিকার কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশানসের ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’-এর এক গবেষণামূলক নিবন্ধে। যেখানে এমা রথসচাইল্ড মার্কিন সরকারের দলিলপত্র দিয়ে প্রমাণ করেন যে, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে প্রাণহানির জন্য দায়ী ছিল আসলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।

বাংলাদেশ ১৯৭৩ এবং ১৯৭৪ সালে বাণিজ্যিক বাজার থেকে আমেরিকান খাদ্য ক্রয় করেছিল। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট বিশৃঙ্খলার ফলাফল বর্ণনা করে, যেখানে খাদ্য নীতি উদ্দেশ্যহীনভাবে বাজারে গৃহীত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের প্রথমাংশে বাংলাদেশ সরকার গমের আমদানি চাহিদা পূরণের জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। বিদ্যমান উচ্চ বাজার দরের এই ক্রয়গুলো স্বল্প মেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করার কথা ছিল। ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে বাংলাদেশ সরকার, যা তখন চরম বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ছিল, এই ঋণটি পেতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে আমেরিকান গম কোম্পানিগুলোর দুটি বৃহৎ বিক্রয় যেগুলো শরতে সরবরাহের কথা ছিল সেগুলো বাতিল করা হয়। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ পেতেও ব্যর্থ হয়।

এরই মধ্যে পিএল (পাবলিক ল) ৪৮০ (ফুড ফর পিস) কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের খাদ্য সহায়তা প্রদানের চুক্তিটি বিলম্বিত হয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা গোপনে আলোচনা করছিলেন যে, বাংলাদেশ সহায়তা পাওয়ার অযোগ্য হয়েছে কি না। কারণ তারা মার্কিন কূটনীতি উপেক্ষা করে বছরের প্রথমাংশে কিউবার কাছে পাট বিক্রয় করেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের একজন আর্থিক কর্মকর্তা পরবর্তী সময়ে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, ‘অন্ততপক্ষে আর্থিক দপ্তরে’ কর্মকর্তারা ভয়াবহতা অনুযায়ী উত্তরণের বিষয় বিবেচনা করেছিল যেটিতে দুর্ভিক্ষ রোধ করা সবচেয়ে কার্যকর হতো। যখন ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আমেরিকার খাদ্য বাংলাদেশে পৌঁছেছিল তখন শরতের দুর্ভিক্ষ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

তাই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের জন্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মুখ্য বিষয় ছিল। বঙ্গবন্ধু তখন দেশি মুনাফাখোর, চোরাকারবারিদের বিষয়েও কঠোর হয়েছিলেন। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, জাতির জনক যে বাকশালের দিকে গেলেন, তার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অবশ্যই ১৯৭৪ সালের সংকটও একটা ব্যাপার। কারণ বঙ্গবন্ধু বাকশালবিষয়ক বক্তৃতায় বারবার ঘুষখোর, মুনাফাখোর, চোরাকারবারি- এ জাতীয় অসৎ লোকদের সতর্ক করেছেন। বাকশাল তথা দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে সবার জন্য সমৃদ্ধি আনতে কাজ করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই বাকশালে সমবায়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। ব্যক্তির সম্পদের সীমাও সীমিত করা হয়। যাতে সমাজে অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আর বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল ঘাতকরা। দেশ পেছন দিকে পড়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভ‚লুণ্ঠিত হলো। অর্থনীতিও মুখ থুবড়ে থাকল। আশার বিষয় হচ্ছে, ২১ বছর অন্ধকার যুগের পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা আবার বাংলাদেশের মাটিতে সরকার গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দেয়, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করে।

মাঝে আমরা আবার দেখেছি বিএনপির কাঁধে ভর দিয়ে মন্ত্রী হয় স্বাধীনতাবিরোধীরা। তবে খুব বেশিদিন তাদের সুখ স্থায়িত্ব হয়নি। শেখ হাসিনা আবার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। একাত্তরের দেশি ঘাতকদের বিচার করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যার দৃঢ়তার কারণে পদ্মা সেতু আজ বাস্তবতার পথে আছে। রাজধানী ঢাকাও মেগাসিটির মতো হয়ে উঠছে, যা মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে পরিপূর্ণ হবে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার দিকেই দেশকে ক্রমশ নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। এর জন্য অবশ্যই সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যারা নেই, তারা দেশকে পেছনে টেনে ধরবে। অতএব, এ বিষয়ে অবশ্যই আমাদের সাবধান থাকতে হবে।

মোহাম্মদ জমির: সাবেক রাষ্ট্রদূত ও প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :