৪৭ বছর ধরে গুলির ক্ষতচিহ্ন নিয়ে বেড়াচ্ছেন উকিল

মো. মুজাহিদুল ইসলাম নাঈম, আলফাডাঙ্গা (ফরিদপুর)
 | প্রকাশিত : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৪:৪৫

১৯৭১ সালের ১১ মে। সকাল আটটার দিকে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার কুসুমদী গ্রামে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। সেদিন ছয়জন নিরীহ গ্রামবাসী প্রাণ হারান, তবে হানাদারদের গুলি খেয়েও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান তিনজন। তাদেরই একজন উপেন্দ্রনাথ বাগচী (উকিল বাগচী) সেই নির্মমতার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন আজও।

সে সময়কার ১৯-২০ বছরের উকিল এখন পেশায় কাঠমিস্ত্রি। চিকিৎসার অভাবে চিরতরে এক পা হারালেও গত ৪৭ বছরেও যুদ্ধাহতের তালিকায় নাম ওঠেনি তার। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের কাছ থেকে এক হাজার টাকা অনুদানের বাইরে আর কোনো সহযোগিতা বা ভাতা পাননি তিনি। এই বৃদ্ধ বয়সে তাই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অতিকষ্টে জীবনটাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন।

নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ উকিল বাগচী। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসের কোনো অধ্যায় খুব ভালোভাবে জানেন না। শুধু জানেন, শরীরে লেগে থাকা কতগুলো গুলির ক্ষতচিহ্নের গল্প, যে চিহ্ন ৪৭ বছর ধরে তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন যুদ্ধের স্মৃতি মনে পড়ে, তখন একা একাই আহাজারি করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক কষ্টে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন উকিল বাগচী। তবু হার মানেননি। কষ্ট হলেও কাঠমিস্ত্রির কাজ করে পরিবারের দেখাশোনা করছেন। নিজ পরিশ্রমের টাকায় পড়ালেখা করাচ্ছেন সন্তানদের।

উকিল বাগচী বলেন, ‘৪৭ বছরের বিভিন্ন সময়ে শরীরের গুলিবিদ্ধ স্থানগুলোতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। হয়তো ভালো চিকিৎসা পেলে সুস্থ হতে পারতাম। কিন্তু অর্থের অভাবে করাতে পারিনি।’

মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামটির লোকজন জানান, আলফাডাঙ্গা সদর বাজারের পাশের মালোপাড়ায় নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর পাকিস্তানি বাহিনী বাজারটিও আগুনে পুড়িয়ে কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ার দিকে যাত্রা করে। তখন জীবন বাঁচাতে দিগি¦দিক পালাতে থাকেন নিরীহ লোকজন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা ঝোপঝাড়ে পালিয়ে থাকা কুসুমদী নমশূদ্র পাড়ার কয়েকজনকে দেখে ফেলে।

মানুষগুলোকে ধরে এনে কুসুমদী গ্রামের বর্তমান আলফাডাঙ্গা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম আকরাম হোসেনের বাড়ির পাশের একটি গর্তের কাছে জড়ো করে পাকিস্তানি সেনারা। খবর পেয়ে সেখানে এগিয়ে যান গ্রামটির আরও অনেক মানুষ।

আক্তার ও হিরু নামের দুজনকে পাঠিয়ে উকিল বাগচীকেও খবর দেওয়া হয় যে তার দাদাসহ পরিচিতজনদের সেখানে আটকে রাখা হয়েছে, তাকেও যেতে হবে। উপেন্দ্রনাথ বাগচী ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, ১১ জন পাকিস্তানি সেনা অস্ত্র হাতে তার পাড়ার কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

পাকিস্তানি বাহিনী সবাইকে সরে যেতে বলে আটজনকে আটকে রাখে। উপেন বাগচীকেও ওই আটজনের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করায়। এরপর নয়জনকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, কার কাছে কী আছে। সবাই যে যার মতো ২/৫ টাকা যা ছিল, বের করে দেন।

কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী এসবের কিছুই না নিয়ে সবাইকে রাইফেল ঠেকিয়ে গর্তে ফেলে দেয়। এরপর ১১ জন পাকিস্তানি সেনা একের পর এক গুলি চালায় নিরস্ত্র নিরীহ নয়জন বাঙালির ওপর।

সেদিন ঘটনাস্থলেই শহীদ ছয়জন হলেন সতীশ মজুমদার, দেবেন বৈদ্য, পঞ্চানন বাগচী, সুকুমার সিকদার, নকুল মন্ডল ও নগেন মন্ডল। উকিল বাগচী ছাড়া বেঁচে যাওয়া অন্য দুজন হলেন ঠাকুরদাস মন্ডল (ভারতে বসবাস করছেন প্রতিবন্ধী অবস্থায়) ও কালিপদ মন্ডল (মৃত)। সবাই কুসুমদী নমশূদ্র পাড়ার বাসিন্দা ছিলেন।

স্থানীয় বুদ্দু ডাক্তার প্রথমে উকিল বাগচীর দেহে প্রাণ আছে বলে নিশ্চিত হন। গুলির তিন ঘণ্টা পর বেলা ১১টার দিকে জ্ঞান ফেরে তার। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে এক গ্লাস জল খেতে চান। গ্রামের সোনা মিয়া জলপান করান। পরে জামসেদ, জালালসহ আরও কয়েকজন আহত উপেন্দ্রনাথ বাগচীকে বাড়িতে রেখে আসেন।

পরিবারের কেউ তখন বাড়িতে ছিলেন না। সবাই উপজেলার চরডাঙ্গা মধুমতি নদীর পারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। খবর পেয়ে ছুটে এলেও উপেন্দ্রনাথ বাগচীকে চিকিৎসা করার মতো পরিবেশ পাওয়া যায় না। চার দিন পর বোয়ালমারী উপজেলার কালিনগর বাজার থেকে ব্যান্ডেজ এনে বাড়িতে কোনোমতে চিকিৎসা করা হয়। এর পর থেকে এক পা প্রতিবন্ধী হয়ে আছে তার।

(ঢাকাটাইমস/১৯ডিসেম্বর/প্রতিবেদক/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :