মেগা প্রকল্প-৩

স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে রূপপুরে

মহিউদ্দিন মাহী
 | প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৮:৩৯

পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বাংলাদেশের একক বৃহত্তম এই প্রকল্পের ২০ শতাংশ কাজ। সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ হলে ২০২৩ সালের শুরুর দিকে জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর এর পরের বছরই যোগ হবে দ্বিতীয় ইউনিটের আরও ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ফলে গোটা বাংলাদেশের আনাচ-কানাচে পৌঁছে যাবে বিদ্যুৎ। যার ফলে দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন।

ঈশ^রদীর পদ্মা নদীর পাড়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন নেতৃত্ব দিচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ। ২০২৩ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ হবে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে। এই দুই ইউনিট থেকে ২৪০০ মেগাওয়াাট বিদ্যুৎ যোগ হবে জাতীয় গ্রিডে। বর্তমানে সার্বিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বরং বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত দেশ হিসেবে বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

কাজের অগ্রগতি

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রথম ইউনিটের কাজ ২০ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বছরভিত্তিক বিভিন্ন লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। সেগুলো নির্ধারিত সিডিউল অনুযায়ী চলছে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটি চালু হবে বলে আশা করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতাধীন পাঁচ হাজার ৮৭ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। গত বছরের ৩০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম কংক্রিট পোরিং অনুষ্ঠান উদ্্যাপনের মধ্য দিয়ে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়। ওই দিনই উদ্বোধন করা হয় মূল প্রকল্প নির্মাণকাজ।

এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়ের কাজও শুরু হয় গত বছরের ৩০ নভেম্বর থেকে। এরই অংশ হিসেবে বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল স্থাপনা ‘রি-অ্যাক্টর বিল্ডিং (উৎপাদন কেন্দ্র)’ সহ অন্যান্য স্থাপনার ২০১৮ সালের জন্য নির্ধারিত মাইলস্টোনসমূহের কাজ ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ হয়েছে।

আর চলতি বছরের ১৪ জুলাই দ্বিতীয় ইউনিটের কংক্রিট পোরিং এর কাজ শুরু হয়। ইতোমধ্যে প্রথম ও দি¦তীয় ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনা যেমন রি-অ্যাক্টর বিল্ডিং, রি-অ্যাক্টর অক্সিলিয়ারি বিল্ডিং, টারবাইন বিল্ডিং, নরমাল অপারেশন পাওয়ার সাপ্লাই বিল্ডিংয়ের নির্মাণকাজসহ আরও বিভিন্ন ধরনের ৫০টি সহায়ক স্থাপনা/ ফ্যাসিলিটিজের নির্মাণকাজ চলমান আছে।

এরই অংশ হিসেবে ডিসেম্বরের মধ্যেই ৭০টি মাইলস্টোনের কাজ শেষ হবে। প্রথম ও দি¦তীয় ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।

অত্যাধুনিক সেফটি ইকুইপমেন্ট

প্রথম ইউনিটের ফাউন্ডেশনের ওপর বিভিন্ন ধরনের অবজেক্ট নির্মাণের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে কোর ক্যাচার নামক একটি অত্যাধুনিক সেফটি ইকুইপমেন্ট (কোর ক্যাচার) স্থাপন করা হয়েছে। এটা বিশে^র সর্বাধুনিক কোর ক্যাচার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. মো. শৌকত আকবর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে বিশে^ ৪৫০টিরও অধিক পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে। রূপপুর পাওয়ার প্লান্ট ব্যতীত বিশে^র মাত্র দুটি পাওয়ার প্লান্টে এ ধরনের অত্যাধুনিক সেফটি ব্যবস্থা সংবলিত কোর ক্যাচার রয়েছে। বর্তমান সরকার এ ধরনের অত্যাধুনিক নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্বে দিচ্ছে এবং এই ধরনের সবচেয়ে আধুনিক সেফটি ইকুইপমেন্ট স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হচ্ছে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, দি¦তীয় ইউনিটের রি-অ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনের কাজ প্রায় শেষ। আর বাকিগুলোর কাজ শুরুর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দুটি ইউনিটের চারটি কোরিং টাওয়ারের তলদেশসহ রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিচের মাটির সুস্থিতিকরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এই মাটি সুস্থিতির কাজে ডিপ সয়েল মিক্সিং টেকনোলজি উপমহাদেশে প্রথম বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ধরনের মাটি সুস্থিতির মাধ্যমে ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম স্থাপনা নির্মাণে নিশ্চয়তা তৈরি হয়।’

দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ড. মো. শৌকত আকবর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য কাজের যে সিডিউল করা হয়েছে, সেই সিডিউল অনুযায়ী কাজ চলছে। কোনো ধরনের ব্যত্যয় নেই। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা কাজ শেষ করতে পারব।’

তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে ধরনের গাইডলাইন রয়েছে, তা হুবহু অনুসরণ করা হচ্ছে।’ বিশে^র মধ্যে সর্বাধুনিক এবং সবচেয়ে নিরাপদ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।

সেফটি ও মানের নিশ্চয়তা

এক প্রশ্নের জবাবে দেশের সবচেয়ে বড় এই আর্থিক প্রকল্পের পিডি বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ছাড়াও এখানে রাশিয়ান ফেডারেশন বিদ্যুৎ চুল্লির বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট নির্মাণ করছে। এগুলোর মধ্যে রি-অ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল, স্টিম জেনারেটর, প্রেশারাইজারসহ বিভিন্ন রকমের যন্ত্রপাতি নির্মাণ করছে রাশিয়া। এ ছাড়া এখানে অত্যাধুনিক সেফটি ইকুইপমেন্ট এবং সেফটি ফিটার্স সংযোজন করা হচ্ছে, যা পাওয়ার প্লান্টে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা শূন্যের কোটায় নামিয়েছে। তার পরও পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা সংযোজনের ফলে বিওন্ড ডিজাইন বেসিস অ্যাকসিডেন্ট ঘটলেও প্রকল্পের বাইরে ৩০০ মিটারের মধ্যে জনগণের নাগালে কোনোভাবেই তেজস্ক্রিয়তা বিকিরণ ছড়াবে না।’

শৌকত আকবর বলেন, ‘বাংলাদেশ পারমাণবিক বিশে^ পা রেখেছে। আমরা সবাই এ বিষয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছি। কিন্তু আমরা আত্মবিশ^াসী প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে নিরাপদেই শেষ হবে। প্লান্টের কমিশনিং পর্যায় থেকেই বাংলাদেশের বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীরা প্লান্টটি পরিচালানর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি এবং ২০২২ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় সকল জনবলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালের জন্য নির্ধারিত প্রায় ১০০ জনবলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নিয়োজিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নবীন বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী রাশিয়ান ফেডারেশনে প্রশিক্ষণরত রয়েছেন। আগামী ২০১৯ সালে আরও ৪০০ জনবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান আছে।’

প্রকল্পের পরিচালক বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আইইএর অনুশাসন ও গাইডলাইন এবং বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কর্তৃপক্ষের ইস্যুকৃত লাইসেন্সসমূহের শর্তাবলি এবং এ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ রাশিয়ান ফেডারেশনের টেকনিক্যাল কারিগরি এবং আইনি বাধ্যবাধকতা হুবহু অনুসরণ করা হচ্ছে। নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতি উৎপাদনে সেফটি এবং মান নিশ্চিত করা হচ্ছে।’

প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, পাঁচ স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকায় এ প্রকল্পে দুর্ঘটনা ঘটার কোনো শঙ্কা নেই। যদি কোনো অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা ঘটেও, তবে তাতে কোনো ক্ষতি হবে না। দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্তের রেকর্ড অর্জনে সক্ষম হবে।

প্রকল্প শুরুর কথা

২০১৩ সালের ২ অক্টোবর এই প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২০০ মেগাওয়াট পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেন।

আর্থিক ব্যয়ের আকারে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ঈশ্বরদীর রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

প্রকল্পে আন্তসরকার ঋণচুক্তির মাধ্যমে রুশ সরকারের কাছ থেকে নেওয়া হবে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ লন্ডন আন্তব্যাংক সুদহারসহ (লাইবর) এ প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, ২০২৩ সালে রূপপুর প্রকল্পের মাধ্যমে আলোকিত হবে বাংলাদেশ। ২০২১ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিটটি চালুর পরিকল্পনা থাকলেও কাজের অপ্রগতি না হওয়ায় এখন তা পিছিয়ে ২০২৩ সাল নির্ধারণ করা হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহার

জিম্মি নাবিকদের মুক্তির আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডিএনসিসি কার্যালয় সরানোর মধ্য দিয়ে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু 

বিএসএমএমইউ উপাচার্যের দায়িত্ব নিলেন দীন মোহাম্মদ, বললেন ‘কোনো অন্যায় আবদার শুনব না’

সাত বিভাগে ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে

বাংলাদেশে মুক্ত গণতন্ত্র বাস্তবায়নে সমর্থন অব্যাহত থাকবে: যুক্তরাষ্ট্র

সীমান্তে নিহত দুই বাংলাদেশির লাশ ফেরত দিলো বিএসএফ

ট্রেনে ঈদযাত্রা: পঞ্চম দিনের মতো অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু

৫০ হাজার টন ভারতীয় পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :