নতুন বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বই উৎসব

সফিউল আযম
 | প্রকাশিত : ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৪৫

শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। একটি জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। আর এই বিষয়টি মাথায় নিয়েই বর্তমান সরকার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে সারাবিশ্বে। বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিচ্ছে নতুন বই। এই সময়ে সারাদেশে সাড়ম্বরে বই উৎসব পালিত হচ্ছে। নতুন বই শিক্ষার্থীদের জন্য এক অভিনব উপহার।

রানু মা-বাবার একমাত্র সন্তান। লেখাপড়ায়ও খুব ভালো। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। কিছুদিন হলো বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। রানু অধির আগ্রহে বসে আছে কখন তার হাতে নতুন বই আসবে। অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না রানুর। সে তার মা-বাবাকে বলে বছর শেষ হতে আর কত দিন বাকি। বাবা তাকে বললেন কেন মা? সে বলল আমি নতুন বই এর অপেক্ষায় আছি। মা-বাবা হেসে বললেন আর কিছুদিন পরেই তুমি তোমার হাতে নতুন ক্লাসের বই পেয়ে যাবে।

বাংলাদেশের মতো দেশে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মাঝে বই বিতরণ একটি যুগান্তকারী ও সাহসী পদক্ষেপ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর ২০১০ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ শুরু হয়। এ কার্যক্রম সারা পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯০টি বই বিতরণ করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ৩৭ লাখ ৬ হাজার ৮৯৫ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের এক কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৮ কোটি ৭৩ লাখ ৮৫ হাজার ৯২১টি এবং প্রাথমিক স্তরে দুই কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২৪ হাজার ৪০৫টি বই বিতরণ করা হয়। এছাড়াও প্রাক-প্রাথমিকের ৩৪ লাখ ১১ হাজার ১৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৬৮ লাখ ২৩ হাজার ৬৪৮টি বই; প্রাক-প্রাথমিকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৫৮ হাজার ২৫৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য পাঁচটি ভাষায় এক লাখ ৪৯ হাজার ২৭৬টি বই বিতরণ হয়। আরও উল্লেখযোগ্য হলো দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য ৮ হাজার ৪০৫টি ব্রেইল বই বিতরণ করা হয়।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে জানা যায়, সারাদেশে ৯৫ শতাংশ বই পৌঁছে গেছে। ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে সারাদেশের ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ করা হবে।

বছরের প্রথম দিনে শিশুদের মাঝে বই বিতরণের ফলে সবার মাঝে একটা উৎসব বিরাজ করে। শিশুরা সারাবছর এই দিনটির অপেক্ষায় থাকে। বই উৎসবের প্রধানতম সফল একটি দিক হলো শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা। সকল শিশুকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। নতুন শ্রেণি, নতুন বই। এটি শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রেরণা জাগায় এবং উৎসাহ সৃষ্টি করে। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছর বই উৎসব একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দরুন নববর্ষের প্রথম দিন না হয়ে ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।

এই কার্যক্রমের আগে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হতো বই বিতরণ নিয়ে। বছরের শুরু হলেও বই ঠিকমত পৌঁছাতে পারতো না শিশুদের কাছে এরকম অভিযোগ ছিল সব মহল থেকেই। অভিভাবকদের অভিযোগও ছিল বিস্তর। নিম্নমানের বই, নিম্নমানের কাগজ, অস্পষ্ট ছাপা, ছাপার গুণগত মান, সব কিছু নিয়েই এক ধরনের সমন্বয়হীণতার বিষয়টি আলোচিত ছিল। সংশয়ে থাকতেন অভিভাবক ও শিক্ষকরা। সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বিভিন্ন শ্রেণির বই বছরের পর বছর পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রকাশকরা। বিনামূল্যে বিতরণের বই বিক্রি হতো কালো বাজারে দেদারছে। বইয়ের সঙ্গে নোট বই কিনতে অভিভাবকদের বাধ্য করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বর্তমান সরকারের এই প্রশংসনীয় উদ্যোগটি সব নেতিবাচক সংবাদকে ছাপিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

বর্তমানে শিক্ষার্থীর হাতে ঝকঝকে ছাপা রঙিন বই দেওয়া হচ্ছে। ফলে বই সংগ্রহ করার দিনটি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক আকাঙ্ক্ষার এবং আনন্দের। নতুন রঙিন বই শিশুদের বই পড়ার আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। সঠিক পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা থাকলে অনেক অন্তরায় দুর করা যায়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণসহ শিক্ষাখাতে বাজেটের এক উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ জাতির জন্য সত্যিকার অর্থেই লাভজনক তা বাস্তবতার নিরিখেই প্রমাণিত হয়েছে। দেশের সামগ্রিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বই বিতরণ, দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই বিতরণ ও নারীদের অবৈতনিক শিক্ষার পদক্ষেপ, শত চ্যালেঞ্জের মাঝেও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন বিশ্বে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

এখনো কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়, সরকারি বিনামূল্যের বই এখনো বাজারে পাওয়া যায়। তবে এই হার খুবই নগণ্য। যতই নগণ্য হোক, বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। দেশে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণকে ঘিরে যে একটি চক্র সবসময় সক্রিয় থাকে, তাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। সরকারকে এক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। বই উৎসব যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, শিক্ষার মানবৃদ্ধিতেও আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে গুণগত মানবৃদ্ধি না হলে একটা পার্থক্য থেকেই যাবে। শিশুদের পাঠদান প্রক্রিয়া আরো অধিক কার্যকর ও আনন্দমুখর করতে নানমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে শিশুরা দৈনন্দিন পাঠ শেষ করতে পারে এমন কিছু উপকরণ তৈরি ও সরবরাহ করা প্রয়োজন। বর্তমানে শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার হার খুব নগণ্য, এটিকে শূন্যের কোটায় আনা প্রয়োজন। বই উৎসব যেভাবে দেশের আনাচে কানাচে, তৃণমূলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সেভাবে মানসম্মত শিক্ষার আন্দোলন পৌঁছাতে হবে দেশের প্রতিটি প্রান্তরে, ঘরে ঘরে। বিশ্বায়নের যুগে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে যে চ্যালেঞ্জ সরকার নিয়েছে, সেটিকে আরো বেগবান করা সময়ের দাবি। পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষাকে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে কোমলমতি শিশুদের মনে দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতার বীজটি বপন করতে পারলে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সময়ের ব্যাপার মাত্র।

সফিউল আযম: এডিটর ইন চিফ, ইয়ুথ জার্নাল

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :