হবিগঞ্জ-৪ আসনে মাহবুব আলীর সম্ভাবনা উজ্জ্বল

প্রকাশ | ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৪০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৯:৪২

মাসউদুল কাদির

নির্বাচনী এলাকা হবিগঞ্জ-৪। বলা চলে আওয়ামী লীগের দুর্গ। স্বাধীনতার পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া আর কেউই পাস করতে পারেননি। মাধবপুর-চুনারুঘাট নিয়ে গঠিত আসনটিতে জনগণের কাছে নিজেকে চেনাতে পেরেছেন বর্তমান সাংসদ অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। দল দর্শন, ব্যক্তিত্ব, বাবার পরিচয় নিয়ে অনন্য এক অবস্থানে আছেন। এলাকায় তিনি নিজের বাবাকে অতটা মেলে ধরেননি। তার বাবা আসাদ আলী মাওলানা মুক্তিযুদ্ধের এক বীরসেনানী ছিলেন। মাধবপুর-চুনারুঘাটের অনেক আলেমও সে কথাটা হয়তো জানেন না। একটি শান্ত ও সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে তার জন্মের কথাও ওরকমভাবে প্রচার পায়নি। নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রেখে আওয়ামী লীগের ইমেজটাই সবচেয়ে বড় করে তিনি প্রচারে নেমেছেন।

এবার বলা যায়, অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীকে বিজয় পেতে বিএনপি অনেক বেশি সহযোগিতা করছে। কারণ, বিএনপির প্রার্থী নেই এখানে। মনোনয়ন পাননি বিএনপির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সল। অবশ্য যে কোনো কারণেই হোক, তিনি জনপ্রিয়। অন্তত মাধবপুরের বেশ কয়েকটা গ্রামে তিনি তুমুল জনপ্রিয়। মূল কারণ হলো, সবসময় ওই এলাকার জনগণ তাকে কাছে পায়। কিন্তু মাধবপুরের খড়কি-খাটুরা-বরগ এলাকাকে বলা হয় সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সলের পকেট। অবশ্য এই পকেট ছিঁড়েও যথেষ্ট পরিমাণের ভোট অতীতে বাগিয়ে নিয়েছে নৌকা। নৌকা সমর্থকদের এক সময় এই এলাকায় নাজেহাল হতেও দেখেছি। যার যেখানে প্রভাব তার সেখানে কাবাব। অন্যদের পালিয়ে পালিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থন করতে দেখেছি। ৯১ এ আমার বয়স খুবই কম ছিল। একটা মিছিলে যাওয়ার সাহস ছিল না। তবে পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতাম। একটা লম্বা মিছিল বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। ধানের শীষ, ধানের শীষ বলে বলে। আমি অবাক হলাম, আমাদের পাশের বাড়ির হিরা মিয়ার টিনের ঘরটায় মিছিলের প্রতিটি লোক একটা করে আঘাত করে করে যাচ্ছে। আমি কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। ওই বাড়ি থেকে কেউ কোনো হামলাও করেনি। কেউ ইট পাটকেল নিক্ষেপ করেনি। পরে আমি বড় একজনের কাছে জানতে চাইলাম, সবাই এই ঘরে আঘাত করছে কেন? তিনি বললেন, এরা নৌকা করে। এ জন্যই।

অনেক দিন হয়ে গেল। সেই হিরা মিয়া আর নেই। তাদের সন্তানরাও আগের মতো ভালো নেই। সম্ভবত সেই বাড়িটিও তার সন্তানেরা রক্ষা করতে পারেনি। আমাদের গ্রামে যারা অতীতে জীবন দিয়ে আওয়ামী লীগ করেছে তাদের খুব বেশি উন্নতি করতে আমি দেখিনি। তবে যারা ধানের শীষের সঙ্গে ছিল তাদের পরিবর্তন দেখেছি। অনেকেই সুবিধার জন্য দল ত্যাগ করে। আবার সুবিধার জন্যই হয়তো ফিরেও যাবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা লালন করে, শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতিকে যারা লালন করে তাদের কদমের ভিত খুবই মজবুত। অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূলের এসব কর্মীরা তাদের ত্যাগের খবরও জাতীয় নেতাদের কাছে পৌঁছাতে পারে না। তারা নৌকা নৌকা করেই খুশি। এক কাপ রং চা-তেই তাদের প্রশান্তি।

খেলাফত মজলিসের খুব বর্ষীয়ান নেতা, দলের মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চু এবার তেইশ দলীয় জোটের মনোনয়ন পেয়েছেন। স্বভাবতই মনক্ষুণ্ন বিএনপি পাড়া। দেশের অন্যান্য জায়গার খেলাফত প্রার্থীরা শতগুণে প্রচারে এগিয়ে আছেন। নিজের উপজেলা মাধবপুরেই এখনো আওয়াজ পৌঁছেনি। এর কারণও আছে। বিএনপির নেতাকর্মীরাও এখনো তার পক্ষে মাঠে নামেননি। সামনে নামবেন বলেও মনে হচ্ছে না। সাবেক এমপি শাম্মি অবশ্য চুনারুঘাটের ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ধানের শীষের পক্ষে হ্যান্ডবিল বিতরণ করেছেন। এটাও খুবই ভালো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, স্থানীয় বিএনপি আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে আগেই। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছিল।

সম্ভবত ২০০৮ সালে আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চু মনোনয়ন নিয়ে অনেকগুলো গাড়ি করে নিজের এলাকায় এলে পথে পথে গাড়িতে পাথর মারা হয়। সাধারণ মানুষও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। নিজের গ্রামে গিয়ে থিতু হন। সেখানে একটি পথসভা করে জানান দেন তিনি মনোনয়ন পাচ্ছেন। এবার অবশ্যই আগের তুলনায় আরও বিপুল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি।

তেইশ দল ও ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রভাবই ধানের শীষে লাগছে না- এটা হলফ করেই বলা যায়। মাধবপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এককালে যারা ধানের শীষ ধানের শীষ করতো, তারাই এখন নৌকা নৌকা করছে। একসময় আহমাদ আবদুল কাদের বাচ্চু মিনার মার্কায়ও নির্বাচনে লড়েছিলেন। তখন অনেক আলেম উলামা তার সঙ্গ দিয়েছিল। ভোটের রাজনীতিতে এবার সেই আলেম উলামাকেও তিনি আগের মতো তার পক্ষে নিতে পারেননি। মিছিল মিটিংয়ে দেখা যায়নি।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আলেমগণ এখন আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি মাঠে না থাকলেও মৌনভাবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির সঙ্গেই কাজ করছেন। কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের পক্ষে সরাসরি কাজ না করলেও বিরোধিতা করছেন না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলেমদের সঙ্গে দূরত্ব কমানোর জন্য গেল পাঁচ বছর দারুণভাবে কাজ করেছেন। সফলও হয়েছেন। বিশেষত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাসনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন, কওমি মাদ্রাসার হাজার হাজার ফারেগিনদের সরকারি চাকুরি প্রদান, হজবিষয়ক সমস্যা সমাধান, কওমি মাদ্রাসায়  জঙ্গি না থাকার ঘোষণা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। আর এসব কারণেই আহমদ আবদুল কাদের বাচ্চুও আলেমদের সঙ্গ পাচ্ছেন না। অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীই হবিগঞ্জ-৪ আসনে এখন সর্বেসর্বা। তাকে টেক্কা দেয়ার মতো প্রতিপক্ষের কোনো অবস্থান নেই।

স্থানীয়দের অনেকের কাছে শোনা গেছে, যদি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সল নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক পেতেন তাহলে অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর সঙ্গে প্রতিযোগিতাটা হতো। অবশ্য ‍যুদ্ধাপরাধীর দায়ে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়সলের বড় ভাই সৈয়দ কায়সার বড় দুই দলের বাইরে থেকে নির্বাচন করে প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।  কার্যত মাহবুব আলীর বিজয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা নেই। ৩০ ডিসেম্বর কেবল নৌকার বিজয়ের জন্য অপেক্ষা মাত্র। বিএনপির রেড আর আওয়ামী লীগের গ্রিন- বড়ই আশির্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে অ্যাডভোকেট মাহবুব আলীর জন্য। একজন আলেম মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তিনি, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলই দেখছি।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, আলেম মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম ফোরাম