বালুচরে ঢেকেছে প্রমত্তা তিস্তা

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:০৯

রাহেবুল ইসলাম টিটুল, লালমনিরহাট

বর্ষায় পানিতে ফুলে ফেঁপে খরস্রোতা তিস্তা নদী শীতে সেই পানির অভাবেই শুকিয়ে যেন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণে ১২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, ধু ধু বালুচর।

লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার পানিশূন্য তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। প্রমত্তা নদীর বুকে ছুটে চলা জেলে-মাঝিমাল্লাদের নেই আগের মতো কর্মব্যস্ততা। থমকে গেছে তাদেরসহ তিস্তাপাড়ের হাজারো পরিবারের উপার্জন। মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বিস্তীর্ণ জনপদের লাখো মানুষ।

অথচ পানিপ্রবাহ সচল ও নদীশাসন হলে তিস্তার  দুই তীরে ফসলের বিপ্লব ঘটবে। উদ্যোগ নিলে এ পানিপ্রবাহে বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও সম্ভব। এ দাবি করে আদিতমারী উপজেলার গোবর্ধন তিস্তাপাড়ের সমাজকর্মী ফারহানা আক্তার বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দরকার। সেই সঙ্গে জনকল্যাণে নদীশাসন করতে হবে। না হলে তিস্তাপাড়ের মানুষ দেশের উন্নয়নের বিপরীতে বোঝা হয়েই থাকবেন।’

ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ঐতিহাসিক তিস্তা নদী। যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবেশী দেশ ভারত গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তার পানিপ্রবাহ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আমাদের দেশে। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপরই বাংলাদেশকে পানি দেয় ভারত। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় এদেশে বন্যা হয়। পক্ষান্তরে শুষ্ক মৌসুমে চাহিদা অনুসারে পানি মেলে না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত এদেশে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন হলেও সুফল মেলেনি।

সরেজমিন জানা গেছে, দেশের অন্যতম বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজও অকার্যকর হওয়ার উপক্রম। নদীতে দিনভর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলেরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। হেঁটেই তিস্তা পাড়ি দেওয়া যায় বলে খেয়াঘাটের মাঝিদের নৌকা বাইতে হয় না, বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন তারাও। কেউ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও কেউ আবার তিস্তা ব্যারাজের সামনে সামান্য যেটুকু পানি আছে, তাতেই পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণের আনন্দ দিয়ে সামান্য আয়ে জোটাচ্ছেন ডাল-ভাতের টাকা।

পানির অভাবে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে গাছপালা। তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির পাখিও চলে গেছে অন্যত্র। নানা প্রজাতির মাছের মধ্যে জনপ্রিয় বৈরালী/বুরাল মাছও পানির অভাবে বিলুপ্তির পথে।

নদীতে তিস্তা রেলসেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গঙ্গাচড়া শেখ হাসিনা সেতু থাকলেও হেঁটেই পার হতে দেখা গেছে অনেককে। তিস্তার বুকে জেগে ওঠা চরের বালুতে ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন সবজির চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে মরে যাচ্ছে। বেশি পরিশ্রম ও প্রতিদিন সেচ দিয়ে চাষাবাদ করলেও আশানুরূপ ফলন না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।

তিস্তাপাড়ের জেলে সাইদুল ইসলাম জানান, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সংসার চলে ভরা তিস্তায় দিনভর মাছ ধরে। এখন পানি না থাকায় মাছ কম, তাই আয়ও কম। বর্ষাকালে বেরালী, আইর ও বোয়াল মাছ পাওয়া গেলেও এখন যাচ্ছে না। ফলে আগে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হলেও এখন তিস্তা ব্যারাজের সামনের সামান্য পানিতে জাল বেয়ে আসছে মাত্র ১৫০-২০০ টাকা। যা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।

নৌকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন জানান, বর্ষাকালে খেয়া পারাপারে ও জেলেদের নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন পানিশূন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। তাই তিস্তা ব্যারাজে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নৌভ্রমণের আনন্দ দিয়ে ২০০-৩০০ টাকা আয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

তিস্তা ব্যারাজ এলাকার রাশেদুল ইসলামও বর্ষা মৌসুমে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতেন। এখন মাছ না থাকায় তিস্তা থেকে পাথর আরোহন করছেন তিনি। প্রতি সিএফটি মাত্র ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি করে সামান্য আয়ে চলছে তার সংসার।

তিস্তাপাড়ের কৃষক তাহাজুল ইসলাম, আবুল মিয়া ও খালেক বলেন, বর্ষাকালে ভারত প্রচুর পানি ছেড়ে দেওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানিসহ ঘরবাড়িহারা হন এ অঞ্চলের মানুষ। আবার শুষ্ক মৌসুমে ফসল রক্ষার প্রয়োজনীয় পানি দেয় না। ফলে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তাপাড়ের। নদীশাসন ও পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় তিস্তা নদী কৃষকের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আপাতত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা সিলড্রাপ ও ক্যানেলগুলো ভরে রাখা হয়েছে। আরও পানি কমে গেলে সেচ প্রকল্প সচল রাখাই কষ্টকর হয়ে যাবে।