অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ-পরিবেশ

ফরিদপুর প্রতিবেদক
 | প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:২৫

অনুমোদন ছাড়া নদীতীরের ফসলি জমি ও সংলগ্ন স্থানে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি অবৈধ ইটভাটায় অবাধে পুড়ছে কাঠ। ইটও পোড়ানো হচ্ছে পরিবেশ দূষণকারী টিনের ছোট ড্রাম চিমনিতে। কেটে নেওয়া হচ্ছে কৃষি জমির টপসয়েল, নদীতীরের মাটি।

ইটভাটাগুলোর পাশে কৃষি জমি, বসতবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বনাঞ্চল থাকার পরও প্রতিনিয়ত নির্গমন করা হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও কালো ধোঁয়া। ফলে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও রয়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

মধুমতি নদীতে বিভক্ত ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সঙ্গে মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার সীমান্তরেখায় এভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটার কারণে সরকারও হারাচ্ছে রাজস্ব। দুই জেলার সীমান্ত হওয়ায় কোনো প্রশাসনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মধুমতি নদীর পশ্চিমপাড়ে মহম্মদপুর উপজেলার মূল ভূখ-। নদীর পূর্বপাড়ে বোয়ালমারী উপজেলার সঙ্গে রয়েছে মহম্মদপুরের রুইজানি ও জাঙ্গালিয়া মৌজার ফসলি জমি। ওই জমিতে রুইজানি মৌজায় মেসার্স নদী ব্রিকস ও এসটিসি ব্রিকস নামে দুটি এবং জাঙ্গালিয়া মৌজায় শরীফ ব্রিকসসহ মোট তিনটি ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ চলছে। ওই এলাকায় আরও কয়েকটি ভাটা স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে।

কোনো ধরনের নিয়মকানুন ও পরিবেশ দূষণের তোয়াক্কা না করেই ভাটাগুলোর টিনের তৈরি ড্রাম চিমনিতে কাঠ জ¦ালিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ইট তৈরির মাটি নেওয়া হচ্ছে মধুমতি নদী থেকে।

‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন- ২০১৩-এ বলা হয়েছে- লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি ইট প্রস্তুতে কৃষিজমি কিংবা পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করতে পারবেন না। অনুমতি ছাড়া খাল, পুকুর, নদীরপাড় কিংবা চরাঞ্চল কেটে মাটি সংগ্রহ করতে পারবেন না।’

গাড়িচালক আইনাল মোল্লাসহ ওই অঞ্চলের একাধিক বাসিন্দার অভিযোগ, ভাটাগুলোতে ট্রাককে ট্রাক ছোট-বড় গাছ পোড়ানো হচ্ছে। মধুমতি নদীর পলি কেটে ইট তৈরি করছেন ভাটা মালিকরা। টিনের ছোট ড্রাম চিমনি ব্যবহারে প্রচুর পরিমাণে কালো ধোঁয়ারও সৃষ্টি হচ্ছে।

বোয়ালমারীর বাসিন্দা রাসেল আহমেদ বলেন, দুই জেলার সীমান্ত এলাকা হওয়ায় সুবিধা নিচ্ছেন অবৈধ ভাটার মালিকরা। তাদের কোনো সরকারি অনুমোদন না থাকায় যে ইচ্ছামতো ছোট-বড় গাছ পোড়াতে পারছেন।

পরিবেশের ক্ষতি ও কাঠ পোড়ানোর অনিয়ম স্বীকারও করছেন ইটভাটার মালিকরা। নদী ব্রিকসের অংশীদার মিনহাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করে আপাতত কাজ চালাচ্ছি। নতুন শুরু করায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ইট পোড়াচ্ছি। ভবিষ্যতে সব নিয়মকানুন মেনে পরিবেশবান্ধব ভাটা করব।’

ওই ভাটার অপর অংশীদার ফয়সাল আহমেদ মাসুদ বলেন, ‘নিয়ম মেনে ইটভাটা করা খুব কঠিন। তাই আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভাটা চালাচ্ছি।’

শরীফ ব্রিকসের অংশীদার শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব ১২০ ফুট উঁচু চিমনি তৈরি করতে প্রচুর ইটের প্রয়োজন। নিজেদের তৈরি ইট দিয়েই ভবিষ্যতে ওই চিমনি বানাব। এ মুহূর্তে আমাদের ভাটার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই। ভবিষ্যতে সব কিছুই পাকাপোক্তভাবে করব।’

এসটিসি ব্রিকসের মালিক জাফর মোল্লা বলেন, ‘আমাদের কোনো অনুমতি নেই। তবে আগামীতে সরকারের কাছে অনুমতির আবেদন জানাব।’

‘অটোভাটা করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। তাই শুরুতে টিনের ড্রাম চিমনিতে ইট পোড়াচ্ছি। এই চিমনিতে কাঠ বা গাছ ছাড়া ইট পোড়ানোও যায় না।’

ফরিদপুর জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সহসভাপতি বোয়ালমারীর মেসার্স রাজ ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী শ্যামল কুমার সাহা বলেন, ‘উপজেলার সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাটাগুলোর সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় মার খাচ্ছি। তারা কাঠ দিয়ে ইট পুড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছেন আর আমরা পরিবেশ দূষণ রোধে বেশি ব্যয়ে কয়লা দিয়ে ইট পোড়াচ্ছি। অনুমোদনের বালাই না থাকায় ওই ভাটাগুলোকে সরকারি কোনো ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। ফলে তারা আমাদের চেয়ে অনেক কম দামে ইট বিক্রি করতে পারছেন।’

ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহসভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘অবৈধ ভাটা স্থাপনে বৈধ ভাটা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা কেউ চান না। অবৈধ ভাটা মালিকদের তো সরকারি রাজস্ব দিতে হয় না, লাইন্সেস নবায়ন করতে হয় না। এর বিরুদ্ধে দুই জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তা না হলে বৈধ ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতিতে পড়তেই থাকবেন।’

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, ‘ইটভাটার বিষয়ে জেলার ভাটা মালিকদের সরকারি নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছি। অনেকেই সেগুলো মেনে চলছেন। পরিবেশের ক্ষতি হয়, এমন কোনো কাজে জেলা প্রশাসনের ছাড় নেই।’

‘ফরিদপুর ও মাগুরার সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা অবৈধ ভাটাগুলোর বিষয়ে মাগুরা জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে পরিবেশ দূষণ রোধে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেব।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :