ইকরা ম্যারেজ মিডিয়া

জাকির হোসেন সেলিম
 | প্রকাশিত : ১১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:১৩

সাইনবোর্ডটা দেখে খন্দকার হাফিজ গাড়ী থামায়। সে কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভোগছে, সে কি গাড়ী থেকে নামবে, নাকি ফিরে যাবে? বিশাল প্রশ্ন, প্রশ্নটা নিজের জন্যই। সে এই ম্যারেজ মিডিয়ার সদস্য হওয়ার ফি নিয়ে ভাবছে না, এই প্রতিষ্ঠানের মালিক ফোরকান সাহেবকে দেয়া কথা নিয়া ভাবছে। পুরো বিষয়টার সাথে তার নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত, এই অবস্হায় ফিরে গেলে সে নিজের কাছেই কথা রাখতে না পারার দায়ে অভিযুক্ত হবে। এখান থেকে ফিরে গেলে, খন্দকার হাফিজ ফোরকান সাহেবকে কথা দিয়ে না আসার কারন হিসাবে কি ব্যাখা দিবে বুঝতে পারছে না। তার সাথে কথা বলে ফোরকান সাহেব নিশ্চয় অন্য কাউকে কথা দিয়েছে। পরস্পরকে কথা দেয়ার এই এক চক্র, একমাত্র সমাধান ফোরকান সাহেবকে দেয়া কথা মতো তার সামনে উপস্হিত হওয়া। খন্দকার হাফিজ আবার সাইনবোর্ডটা দেখে, ইকরা শব্দটার সাথে ম্যারেজ মিডিয়ার সম্পর্ক কি? আরবী শব্দের সাথে জোড়া ইংরেজী শব্দ, বাংলা কোন শব্দ কি ব্যবহার করা যেত না? প্রশ্নটা জমা থাকল, প্রতিষ্ঠানোর মালিক ফোরকান সাহেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

গাড়ীর দরজার হাতলে হাত রেখে খন্দকার হাফিজ আবারো সাইবোর্ডটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে, রাস্তার দুই পাশ দেখে। শহরের সবুজায়ন শুরু হয়েছে। রাস্তার দুই পাশেই বড় বড় কয়েকটা গাছ দেখা যাচ্ছে। যে বাড়ীর গেটের উপরে “ইকরা ম্যারেজ মিডিয়া” লেখা, সেখানেও একটা গাছ আছে। যুবক কদম গাছ, বেশ তরতর করে বেড়ে উঠছে। বসন্তের বিকালের নরম আলোতে চমৎকার দেখাচ্ছে। তরুন পাতার সবুজ রঙ চিক চিক করছে। দুইটা দাঁড কাকপরশ্পরের সাথে খুনসুটি করছে। সে কদম গাছটাকে পুরুষ বাচক বলে সন্মোধন করলো কেন? যুবক কদম গাছ বিষয়টা ঠিক না, তার মনে হয় সব গাছই উভয় লিংগ; যৌবনে এই গাছ ফুলে ফুলে শোভিত হবে। গাছের লিংগ উদ্ধারের চিন্তা বাদ দিয়ে খন্দকার হাফিজ গাড়ী হতে রাস্তায় নেমে আসে । রাস্তার ফাঁকাই বলা যায়। আবাসিক এলাকার মধ্যে ইকরা ম্যারেজ মিডিয়া, বানিজ্যিক এলাকার দৃষ্টিকটু কোলাহল নাই।

কেউ দেখলে কি ভাববে ? এইটা আর একটা সমস্যা বটে, সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গী ।

পুরুষ মানুষ ঘটা করে বিয়ে করতে পারে, পাত্রী দেখতে কোন ম্যারেজ মিডিয়াতে গেলেই লোকজনের চোখে লাগে। সমস্যাটা কোথায় ? সমস্যাটা মনে, বয়সও একটা ব্যাপার। খন্দকার হাফিজের এতো কিছু ভাবনার সময় নাই; সে নিজের বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভালই বিপদে আছে।

খন্দকার হাফিজ “ইকরা ম্যারেজ মিডিয়া” লেখা সাইনবোর্ড লক্ষ্য করে এগিয়ে চলেছে। তার মনে হচ্ছে আশপাশের লোকজন তার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে । যৌন ও চর্ম রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে সবাই যেমন সন্দেহের চোখে তাকায় । লোকজনের চোখে সবাই তখন যৌন সমস্যার রোগী, চর্ম ব্যাপারটা প্রথমে ভাবনায় আসে না।

খন্দকার হাফিজ গাড়ী থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকার সময় সামান্য একটা দূর্ঘটনা ঘটে যায়। তাৎক্ষনিক ভাবে সে ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পারে নাই। বিকট একটা গন্ধ তাকে সচেতন করে তুলে, মাথায় বাড়তি কিছু অনুভূত হওয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে তার হাত চলে যায় । তার হাত ভেজা ভেজা লাগে, ভেজা হাত চোখের সামনে ধরতেই খন্দকার হাফিজ “সামান্য দূর্ঘটনার” ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারে।

কলিং বেলের বোতামে টিপ দেয়ার আগে খন্দকার হাফিজ আরো একবার মাথায় হাত দেয়। চুলে লেগে থাকা তরল অংশ ততোক্ষনে মাথার তালু স্পর্শ করেছে। কলিং বেলের শব্দ শুনে মধ্যবয়সী দাঁড়িওয়ালা এক লোক দরজা খুলে দিয়ে সালাম দেয়,

আসসালামুআলাইকুম। তারপরই জিজ্ঞেস করে, গন্ধ কিসের ? বদ গন্ধ।

খন্দকার হাফিজ সালামের উত্তরে কি বলেছে বুঝা যায় না, শুধু জিজ্ঞেস করে,

আপনাদের ওয়াশ রুমটা কোন দিকে?

খন্দকার হাফিজ আধা ঘন্টা পর ওয়াশ রুম থেকে বের হয় । পড়নের জামা কাপড়ে দামী শ্যানেলের গন্ধের লেশ মাত্র নাই। ওয়াশ রুমে মাথা ধোয়ার জন্য কোন সেম্পু ছিল না, খন্দকার হাফিজ মাথা ধোয়ার জন্য বেসিনের পাশে রাখা সেভলন লিকুইড হ্যান্ড ওয়াশের পুরো বোতলটাই শেষ করে ফেলেছে । এখন তার শরীর থেকে ভুর ভুর করে সেভলনের গন্ধ বের হচ্ছে । সে অন্য কারো তোয়ালে ব্যবহার করতে পারে না, মাথা মোছার জন্য টয়লেটের পুরো টিস্যুর রোলটাই ব্যবহার করেছে । ভেজা টিস্যুর অংশ মাথার চুলে লেগে থাকাও বিচিত্র না।

ফোরকান সাহেব প্রতিষ্ঠানটির মালিক, অতি ব্যস্ত মানুষ । গা ভর্তি আতরের গন্ধ নিয়ে কামরায় আসে । শরীর জুড়ে তেলতেলে হাসি। সালাম দিয়ে খন্দকার হাফিজকে জিজ্ঞেস করে,

ভাই সাহেবের শরীর ভাল?

জি, আসার আগে ভালই ছিলাম, এখন শরীর ভাল নাই।

কেন ভাই, কোন সমস্যা? আমার এখানে পাঁচ তারকা হোটেলের পরিবেশ, সব টিপটপ!

আর টিপটপ ! ওয়াশ রুমে তো সেম্পুই নাই । ভাই, আজকের পোগ্রাম বাদ দেন । আরো একটা কাজ করেন, আপনার গেটের সামনের কদম গাছটা কেটে ফেলেন ।

কেন ভাই, কদম ফুল আপনার পছন্দ না ?

না, কদম ফুল পছন্দের কথা আসছে না । কাক আমার পছন্দ না । হেগে কি করেছে দেখছেন না । মাথা ভর্তি কাকের গু, পুরো বোতল সেভলন হান্ড ওয়াস সাবান শেষ করে ফেলেছি তবুও গন্ধ যায় নাই । ভাই, আজকের প্রোগ্রাম বাদ । খন্দকার হাফিজ প্রোগ্রাম বাদ দেয়ার কথাটা দ্বিতীয়বার বলে ।

ফুরকান সাহেব হায় হায় করে উঠে । বলেন কি ? পার্টি তো হাত ছাড়া হয়ে যাবে ! ভাই, একটু ম্যানেজ করে নেন, বড় পার্টি, আমার বড্ড লস হয়ে যাবে । আপনি বলেন তো মেশক্ আম্বর আতর মেখে দেই । কাকের গু তো ছাড়, শয়তান গুয়ের গন্ধও দূর হয়ে যাবে ।

শয়তান প্রাকৃতিক কার্য করে নাকি, জানতাম না তো !

কথার কথা বললাম । ভাই এসেই যখন পড়েছেন, পাত্রী দেখার কাজটা শেষ করে যান। আমাদের বাড়তি একটা সার্ভিস আছে, যে কোন গ্রাহক চাইলেই পেতে পারে । ইকরা ম্যারেজ মিডিয়ার নিজস্ব বিউটিসিয়ান আছে, ছেলে এবং মেয়ে দুই পক্ষই এই সেবা নিতে পারে । আপনিও চাইলে নিতে পারেন । আধা ঘন্টা সময় দিলেই হবে, আপনাকে রেডি করে দিবে ।

তিন তলায় ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা রুম । আপনার কি তেমন কোন সেবা চাই ?

খন্দকার হাফিজের মেজাজ মর্জি ভাল না, নিজেকে সংযত রাখতে বেশ কষ্ট করতে হয় । সে বুঝতে পারছে শুধু শুধু এখানে আসা, কাজের কাজ কিছুই হবে না । সে বলে, ফোরকান সাহেব আমার অন্য কোন সেবা লাগবে না । সেভলনের গন্ধটাও খারাপ না, আপনি দেখা-দেখির আয়োজন করেন ।

ঠিক আছে, ঠিক আছে । ফোরকান সাহেবের দূর্ভাবনা কেটে যায় । বলে, উপরে আর একটা পার্টি কথা বলছে, তাদের কথা শেষ হলেই আপনাকে ডাকা হবে । চা নাস্তা সেখানেই দেয়া হবে । চা খেতে খেতে পরস্পরের সাথে পরিচিত হবেন, হা হা হা । হঠাৎ খন্দকার হাফিজের গম্ভীর মুখের দিকে চোখ পড়তেই ফোরকান সাহেব হাসি থামিয়ে কামরা থেকে বের হয়ে যায় ।

ফোরকান সাহেব চলে যাবার পর খন্দকার হাফিজ একা হয়ে যায় । নিরব পরিবেশ, ঘরের এসিটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ডেকে চলেছে । খন্দকার হাফিজ নিজের কথা ভাবে ।

সে এখানে কেন ?

তার কি এই ভাবে নিজের বিয়ের পাত্রী খুঁজার কথা ছিল?

এখন এই সব ভেবে লাভ নাই, সবি সময়েই বাস্তবতা । এই মূহুর্তে সে নিজের বিয়ের পাত্রী দেখার জন্য বসে আছে । অপেক্ষায় আছে, এক সময় ডাক আসবে । খন্দকার হাফিজ নিজের কথা ভাবে । তার মা, বাবা দুই জনের কেউ বেঁচে নাই । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরের বৎসর তার বাবা মারা যায় । তার ছোট দুই ভাই বোন রয়েছে । দুই জনেই তখন স্কুলে পড়ে, মাসুক ক্লাস এইটে আর মমতা ক্লাস সেভেনে । বাবার অকাল মৃত্যুতে মা চোখে অন্ধকার দেখেন । বাবার পেনশন তখনও ম্যাচুওর হয় নাই, অফিস থেকেও উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যায় নাই । জমানো কিছু টাকা, সন্চয় পত্র এই সব নিয়েই মা‘র সাথে তাকেও সংসারের হাল ধরতে হয়, সেই জীবন যুদ্ধের শুরু । নিজের খরচ, সংসারের খরচ, সকালে টিউশনি, ক্লাস শেষে টিউশনি। সংসারের চাকা সচল রাখতে গিয়ে নিজের শখ গুলোর কথা কখনও মনে আসে নাই, প্রেম তো দূরের কথা । পড়াশুনা শেষ, চাকুরীর সন্ধানে ঘুরছে, প্রতিদিন পরিবারের নতুন নতুন আবদার । নিজেকে নিয়ে ভাবনা অন্যায় মনে হতো । এক সময় চাকুরী হয়, তখনও তার যুদ্ধ শেষ হয় নাই । দুই ভাই বোন তখনও পড়াশুনা করছে । তার বিয়ের বয়স চলে যাচ্ছে, সবাই বুঝতে পারছে, কেউ কিছু বলছে না । আগে সংসারটা তো চলুক ! মমতার বিয়ের আগ পর্যন্ত মা তার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকত । মমতার বিয়ে হয়, তার মাও মারা যায় । মাসুকও বড় ভাই এক উপর ভরসা রাখতে পারে নাই । একদিন নিজের পছন্দের একজনকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে আসে । মাসুক এখন চাকুরী করে, তার সিদ্ধান্ত সেই নিতেই পারে, বড় ভাই এর সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করলেও চলে । বৎসর পেরুতেই তাদের সংসারে নতুন অতিথি আসে, রাজকন্যা অহনা, মাসুকের এখন জমজমাট সংসার ।

খন্দকার হাফিজ এখন প্রতিষ্ঠিত । চাকুরীতেও উন্নতি হয়েছে । বাবার সামান্য জায়গার উপর বাড়ি উঠেছে । খন্দকার হাফিজ আয়নায় নিজের পাকা চুল দেখে আর নিজের সংসার খুঁজে । নিজের সংসার পায় না । মাসুকের সংসারে নিজেকে অতিথির মতো লাগে । নিজের বাড়িতেও সে একা ।

তবুও জীবন চলছিল । হঠাৎ করেই মমতা তার জীবনের ধীরে চলা সাবলীল ধারাকে এলোমেলো করে দেয় । মমতা তার বিয়ের জন্য অস্হির হয়ে উঠে । খন্দকার হাফিজ মমতার অতি আগ্রহের সঠিক কারন না জানলেও অনুমান করতে পারে । তাদের বাসায় মাসুকের স্ত্রী কনা সংসার পেতে বসেছে, একা রাজত্ব করছে; আরেক মেয়ে মানুষ হিসাবে মমতার ক্ষানিকটা লাগারই কথা । কনার উপর মমতার আধিপত্য জ্যামিতিক হারে কমছে, মমতা সঠিক পথই খুঁজে নেয় । ব্রিটিশ মডেল, ডিভাইডেড এন্ড রোল । এখন মমতা প্রতি সপ্তাহে কোন না কোন মেয়ের খুঁজ নিয়ে হাজির হয় । মমতার স্বামীও পাত্রী খুঁজার মিশনে যোগ দিয়েছে । বোনকে শাসন করা যায়, বোনের স্বামীকে শাসন করা না । তাদের এক কথা, চল্লিশ এমন কি বয়স ! বিয়ে করতে সমস্যা কোথায় ? অন্য কোন সমস্যা নাই তো !

এটা পুরুষ মানুষের অস্হিত্বের সংকট । বিয়ের ব্যাপারে খন্দকার হাফিজের মত কিংবা অমত কিছুই নাই । কিন্তু রুচির সাথে মিলাতে তো হবে ? মমতার এখনকার পাত্রী তার দূর সম্পর্কের এক ননদ, সদ্য গ্রেজুয়েশন করেছে ।

কনা যখন দেখলো মমতা বিয়ের ব্যাপারে সিরিয়াস তখন সেও উদ্দোগী হয়, জা নিজেদের কেউ হলে সংসারের নিয়ন্ত্রন তার হাতেই থাকবে । কনা তার আত্বীয়ের ভেতর বিভিন্ন পাত্রীর সন্ধান দিতে থাকে । খন্দকার হাফিজ পড়ে সমস্যায় । সে কোন দিকে যাবে ? একদিকে বোনের আবদার, অন্য দিকে ভাই-বৌ এর আবদার । গত সন্ধ্যায় মমতার বাড়াবাড়িতে তার বাসায় গিয়েছিল, উদ্দেশ্য পাত্রী দেখা, পাত্রী মমতার দূর সম্পর্কের ননদ ।

কনা বিষয়টা জানার কথা না, কি ভাবে সে জেনে যায়, বিরাট রহস্য! কনা বিষয়টা ভালভাবে নেয় না, কনা ক্ষোভে ফেটে পড়ে,

দাদা ভাই এইটা আপনি ঠিক করলেন না । আমার একটা মান সম্মান আছে। আমি খালাকে কথা দিয়েছি।

মাসুক তার বৌকে সামলাতে চেষ্টা করে । মিন মিনে স্বভাবের মাসুক বৌ এক কাছে পাত্তাই পায় না। কনা বলেই চলেছে,

কেন আমাকে চুপ থাকতে হবে?

আমার খালাতো বোনের চেয়ে মমতার ননদ বেশী সুন্দরী ? আমি খালার কাছে মুখ দেখাতে পারবো না । কই দাদা ভাই নিজে তো একজন জোগাড় করতে পারলেন না । বিয়ের পাত্রীর জন্য মমতাকেই ধরতে হলো ? নিজে পারলে না হায় কথা ছিল । মমতার ননদ, তাও আপন তো না ! তার কাহিনীকি আমরা জানি না ? আমার খালাতো বোনের সমস্যা কি? তার বিয়ে তো এক মাসও টিকে নাই । ডিভোর্সি বলেই কি সমস্যা ! কত আর শুনা যায় । খন্দকার হাফিজ চুপচাপ কনার সামনে থেকে সড়ে আসে । সে ঠিক করে, ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টানোর আগেই বিয়ে করবে । নিজের চেষ্টাতেই করবে । তাকে নিয়ে মমতা আর কনার সম্পর্ক দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে । শেষ পর্যন্ত কি হবে বলা যাচ্ছে না । হায়রে সংসার !

খন্দকার হাফিজ ঘড়ি দেখে । চল্লিশ মিনিট চলে গেছে তার ডাক আসছে না । আর কতক্ষন অপেক্ষা করতে হবে ? তার চা খেতে হচ্ছে করছে । পাত্রী নিশ্চয় ইকরা ম্যারেজ মিডিয়ার বিশেষ সেবা নিচ্ছে । ফোরকান সাহেব বলেছিল আধা ঘন্টায় তৈরী করে দেবে । মেয়ে মানুষ, সামান্য দেরী তো হতেই পারে । খন্দকার হাফিজ গা হেলিয়ে বসে ।

ঠিক বায়ান্ন মিনিট পর খন্দকার হাফিজ সাহেবের ডাক পড়ে । নীচ তলা হতে সেই দাঁড়িওয়ালার পেছন পেছন দু’তলায় উঠে যায় । দাঁড়িওয়ালা ভাইজান গন্ধের বিবর্তন কি লক্ষ্য করেছে ? তার নাকে নিশ্চয় বদ গন্ধের পরিবর্তে সেভলনের গন্ধ লাগছে ।

খন্দকার হাফিজ যাকে কামড়ায় দেখে তার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না । লাস্যময়ী তরুনী বলা যাবে না, তবে মুখের লাবন্যে তারুন্যের ছাপ রয়ে গেছে । সে মোটেই বিউটিশিয়ানের কামরা ঘুরে আসে নাই । খন্দকার হাফিজ নিজ আসনে বসার আগে কামরায় অপেক্ষমান মহিলা অতিথিকে দেখে, প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশী সময় নিয়েই দেখে । খন্দকার হাফিজ জানে মেয়েটির নাম মায়া । প্রথম যে প্রশ্নটা মনে আসে তা হলো,

এই মেয়ে এখানে কি করছে ?

চোখ দু’টো ফোলা ফোলা, মনে হচ্ছে মাত্রই কান্না শেষ করেছে । খন্দকার হাফিজ নিজ মনে হাসে, সে একটু বেশীই ভাবছে । মায়াও তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকে দেখছে । খন্দকার হাফিজের ভেতর থেকে কেউ একটা সাবধান বানী শুনায়, “এই মেয়ের সাথে বেশী কথা বলা বিপদ জনক” । মায়া কথা বলতে শুরু করার পরেই খন্দকার হাফিজ নিজের প্রকল্পের জোড়ালো ভিত্তি খুঁজে পায় ।

আমার বয়স নিয়ে ভুল বুঝার কোন কারন নাই, আমার বয়স বত্রিশ ।

খন্দকার হাফিজ অবাক হয় । কেউ অপরিচিত কারো সাথে এই ভাবে কথা শুরু করে ? মায়া কি কোন কারনে রেগে আছে ? মায়া নিজের বয়স নিয়ে কয়েকটি শব্দ বলেছে, কোন শব্দই নাকের সম্পৃক্ততা মুক্ত হতে পারে নাই । মানে কি? মেয়েটা কি সত্যি সত্যি কাঁদছিল ? কেউ ম্যারেজ মিডিয়াতে এসে কাঁদে?

না, আমি আপনার বয়সের ব্যাপারে ভুল বুঝেছি না । আপনার বায়োডাটা আমি পড়েছি । নির্লিপ্ত ভাবেই কথাটা বলে খন্দকার হাফিজ । সে নিজের আবেগ সামলে উত্তর দিতে চেয়েছিল, কন্ঠটা বেশী আবেগহীন হয়ে গেছে । মায়ার বিষয়টা কি? এই মেয়ের জন্য ছেলেদের লাইন লাগার কথা । সে কেন ম্যারেজ মিডিয়াতে এসে নিজেই নিজের পাত্র খুঁজছে ? মায়ার বিষয়টা গুরুতর সন্দেহ নাই ।

কতটুকু গুরুতর সেটাই ভাববার বিষয় । খন্দকার হাফিজ ভাবতে শুরু করে ।

মায়ার কি আগে বিয়ে হয়েছিল ? বায়োডাটাতে সেই কথা লেখা নাই । তবে ?

আপনার, আমার ব্যাপারে কিছু জানার আছে? মায়ার প্রথম প্রশ্ন ।

আগের কথাটা প্রশ্ন ছিল না, তার বয়সের ব্যাপারে সাবধান বানী ছিল মাত্র । খন্দকার হাফিজ, মায়ার ব্যাপারে নিজের ধারনাটা ভুলে যায় নাই । নিজের ভেতর থেকে সেই অদৃশ্য কণ্ঠ আবার সাবধান করে । খন্দকার হাফিজ চুপ থাকে ।

মায়া আবার বলে, আজকে আমার দুইটা এপয়েন্টমেন্ট ছিল, আপনার কাছে আসার আগে আরেক জনের সামনে বসতে হয়েছিল । বড় সরকারী চাকুরে, সে আমার বুকের সাইজ কত জানতে চেয়েছে ।

আপনিও কি এমন কিছু জানতে চান?

প্রশ্নটা খন্দকার হাফিজের অস্হিত্বকে নাড়িয়ে দেয় । কোন পুরুষ মানুষ এমন প্রশ্ন করতে পারে ?

খন্দকার হাফিজ কিছু বলে না, মায়াও চুপচাপ । দুই জনেই ক্ষানিক ক্ষণ পরস্পরকে দেখে । অন্য একজন পুরুষ মানুষের বেয়াড়া প্রশ্নে খন্দকার হাফিজ বিব্রত । সে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে । মায়া আবার প্রশ্ন করে,

আপনি কেন বিয়ে করতে চাচ্ছেন ?

খন্দকার হাফিজ সত্যিকার বিপদে পড়ে । সত্যি তো, সে কেন বিয়ে করতে চাচ্ছে ? তার বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনের সত্যিটা কি? সে মিথ্যে কথা বলতে চায় না । কথার প্যাঁচে পড়ে কখনও হয়তো কোন কথা এদিক সেদিক হয়ে যায় । কিন্তু খন্দকার হাফিজ কখনও জেনে শুনে মিথ্যা কথা বলে না । বলার দরকার হয় না, তার মতে মানুষ কখনও কখনও লোভের জন্য মিথ্যা কথা বলে, কখনও মজা করার জন্য, নিজের গুরুত্ব বাড়ানোর জন্যও মিথ্যা কথা বলে । তার কোন কিছুরই দরকার নাই । খন্দকার হাফিজের মিথ্যা কথা বলার দরকার হয় না । সে বিয়ে করার কারন হিসাবে কি বলবে ? নিজের একাকিত্বের কথা ? তাকে নিয়ে মমতা, কনার রেষারেষির কথা ? খন্দকার হাফিজ একটা বাউন্সার দেয়, ব্যাটসম্যান বলে ব্যাট লাগাতে না পারলে পার পেয়ে যাবে, যদি ছক্কা খাওয়ার রিস্ক আছে । সে পাল্টা প্রশ্ন করে,

আপনি কেন বিয়ে করতে চাচ্ছেন ।

এক কথায় বলতে হলে, ছোট বোনের বিয়ের পথ সুগম করতেই আমার বিয়ে করতে চাওয়া । আমার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে না । নিজ পক্ষ সমর্থন করে মায়া জবাব দেয় ।

খন্দকার হাফিজের মনে হয়, বাউন্সার কাজ করেছে, ব্যাটসম্যান বাউন্ডারী পিটানোর চেষ্টা করে নাই, বলটা ছেড়ে দিয়েছে । সে মনে মনে বলে, মায়াকে যতটা ভীতিকর মনে হচ্ছে, সে তা নাও হতে পারে । সে কথা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে অতি সাবধানে ।

এটা আপনার বিয়ে করার কারন হতে পারে, বত্রিশ বৎসর বয়স, বিয়ে করার জন্য একটু দেরীই, আপনার আগে বিয়ে না করতে চাওয়ার কারন কি ছিল ?

বিষয়টা ব্যক্তিগত, তারপরও বলছি । নিজের বুকের মাপই যেখানে বলতে পারি, সেই তুলনায় আপনার প্রশ্নটা মোটেই

ব্যক্তিগত না । বিয়ে না করতে চাওয়ার বিষয়টা বিশ্বাসের প্রশ্ন, আমি পড়াশুনা শেষ করে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছি, চাকুরী করি, নিজের মতো জীবন কাটাবো; এমনটিই চেয়েছি । আমার বায়োডাটায় পড়েছেন, মধ্যবিত্ত পরিবার, তিন বোন, কোন ভাই নাই । মধ্যবিত্ত সংসারে জন্ম হওয়া এক ধরনের অভিশাপ । বৃত্তের বাইরে যাওয়া যায় না, সবাই হায় হায় করে উঠে । এই বয়সে আমার সন্তানের পেছনে পেছনে স্কুলের ব্যাগ নিয়ে ছুটার কথা । আমি দিব্বি চাকুরী করছি ! বিষয়টা সবাই মানতে পারছে না । আমার বড় বোনকে দেখেছি, সে ডিভোর্সি, বিয়ের তিন বৎসর পর আবার বাবার সংসারে ফিরে এসেছে । তার প্রতি দিনের কান্না নিজের বিয়ে নিয়ে আমার আগ্রহ একেবারে সর্ব নিম্ন পর্যায়ে নিয়ে গেছে । অবশেষে ধরা খেয়েছি অন্য জায়গায়, আমার বিয়ে না হলে ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে না । তিন বোনের একজন ডিভোর্সী, একজন বিয়ে করছে না, তৃতীয় জনের বিয়ে হয় কি করে ? প্রতিদিন আত্বীয় স্বজনদের চোখা চোখা কথা, ছোট বোনের মলিন মুখ, তাই ভাবলাম নিজের চেষ্টা নিজেই করি । ব্যাস ! বিসমিল্লাহ বলে আজই ইকরা ম্যারেজ মিডিয়াতে পা রাখলাম ।

খন্দকার হাফিজ হেসে উঠে, যদিও মায়ার কথায় হাসির কোন উপাদান নাই । সে মায়ার কথা বিশ্বাস করছে । তার মন ভাল হয়ে যেতে শুরু করেছে । কামরায় ঢুকার পর হতে একবারও সেভলনের গন্ধ পায় নাই । তার ব্যাপারে মায়া কি ভাবছে জানতে পারলে ভাল হতো ।

সে জিজ্ঞেস করে, আমার ব্যাপারে আপনি কিছু জানতে চান ?

অনেক কিছুই জানতে চাই । কেন এতোদিন বিয়ে করেননি, পুরাতন প্রশ্ন; উত্তর আপনার কাছে তৈরী থাকার কথা ।

তবে কি জানতে চান ? কি চাকুরী করি, পরিবারে কে কে আছে, সবই তো বায়োডাটাতে লেখা আছে ।

সেই সব না । মায়ার চোখ দু’টোও হাসছে । এক দিনের দেখাতেই আপনাকে পছন্দ করতে হবে, বিষয়টা কতটা দূরুহ বুঝতেই পারছেন । তাই শর্টকাট পথে হাঁটতে চাই । আপনার বুকের বাঁকা হাড় কয়টা, সম্ভব হলে গুনে নিশ্চিন্ত হতে চাই ।

বলুন তো আপনার বুকের কয়টা বাঁকা হাড় খুয়া গেছে ?

খন্দকার হাফিজের জন্য একেবারে অভাবিত প্রসঙ্গ । সে অবাক হয়, জিজ্ঞেস করে,

হঠাৎ বুকের হাড়ের কথা আসছে কেন?

দেখুন আপনি কয়টা বিয়ে করবেন জানতে হবে না ? পুরুষের বুকের বাঁকা হাড় দিয়ে স্ত্রীকে তৈরী করা হয়েছে। আপনার বুকের বাঁকা হাড় দিয়ে কতজন স্ত্রী তৈরী করা হয়েছে জানতে হবে না? আমার কতজন প্রতিদ্বন্দ্বী আছে খুঁজ নিতে হবে না?

খন্দকার হাফিজ মায়ার কথায় খুব মজা পায় । এই মেয়ে দেখি রসিকতাও করে ! সে পাল্টা প্রশ্ন করে,

উল্টো করে ভাবুন, আপনি কয়জন পুরুষ মানুষের বুকের হাড় বয়ে বেড়াচ্ছেন ? সেই হিসাবটা আমাকে দিন ।

মায়াও হাসে । কামরাটা ঝলমল করে উঠে । খন্দকার হাফিজ অবাক হয়ে মায়ার হাসি দেখে ।

আহা ! জীবন কত সুন্দর ।

মায়া ফিস ফিস করে বলে, খন্দকার সাহেব; ফোরকান সাহেবের সব পাওনা মিটানো আছে ?

তা আছে, কেন বলুন তো ?

মায়া খন্দকার হাফিজের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আবার প্রশ্ন করে,

আমাদের দুই জনকে এক সাথে বের হতে দিবে ?

না দেয়ার তো কোন কারন নাই । কেন জানতে চাচ্ছেন ? মায়ার ব্যাপারে খন্দকার হাফিজের আগ্রহ বাড়ছে ।

এই সন্ধ্যাটা আপনার সাথে কাটাতে চাই, খোলা আকাশের নীচে বসে দুইজন চা খাব । এই ফাইভ স্টার এ্যারেজমেন্টের চা এ কর্পূরের গন্ধ পাচ্ছি ।

খন্দকার হাফিজ সাথে সাথে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়, মায়াকে উঠতে সাহায্য করতে সাহস করে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় ।

মায়া সাবলীল ভাবে খন্দকার হাফিজের হাত ধরে । দুইজন পাশাপাশি হাঁটছে, গেটের সামনে এসে খন্দকার হাফিজের কদম গাছটার কথা মনে হয় । সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কাক দুইটার না থাকারই কথা । তাদেরও বাসা আছে । খন্দকার হাফিজেরও কি সংসার হবে ?

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :