পাখি দেখতে মানুষের মেলা

প্রকাশ | ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:২৩ | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৩০

রাইয়ান বিন আমিন

ঝিলের জলে লাল শাপলার মেলা। নাম না-জানা হাজারো পাখির কলকাকলি। সকালের সোনালি রোদেও আড়মোড়া ভাঙেনি তাদের। সুদূর সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়া থেকে আসে হরেক কিসিমের পরিযায়ী পাখি। এমন সব পাখি দেখতে ভিড় জমেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে। প্রকৃতি ও পাখিপ্রেমী মানুষেরা দল বেঁধে উপভোগ করছেন পাখিদের চোখ-ধাঁধানো দৃশ্য।

প্রতি শীতেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চোখে পড়ে পাখিদের এই সম্মিলন। ২০০০ সাল থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ আয়োজন করে আসছে পাখিমেলার।

ব্যতিক্রম ছিল না এবারও। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহির রায়হান অডিটরিয়ামের সামনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৮তম পাখিমেলা। এবারের মেলার স্লোগান ‘পাখপাখালি দেশের রত্ন, আসুন করি সবাই যত্ন’। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় বেলুন ওড়ানোর মাধ্যমে মেলার উদ্বোধন করেন জাবির উপাচার্য ফারজানা ইসলাম।

মেলার সহ-আয়োজক হিসেবে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টার, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, আরণ্যক ফাউন্ডেশন, আইইউসিএন এবং বাংলাদেশ বন বিভাগ। মেলা উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্ত থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী, বয়োবৃদ্ধসহ হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করে ক্যাম্পাসে।

গতকাল পাখিমেলায় ছোট্ট রাইদ আসে মা আর মামার সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট-সংলগ্ন লেকে লাল শাপলার মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির বাহারি খেলায় মেতে ওঠার দৃশ্য দেখে আনন্দ যেন ধরে না তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র রাইদের।

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে পাখি দেখতে আসা রাইসার ইচ্ছা করে পাখিদের মতো করে উড়তে। পাখির পাল যখন দল বেঁধে আকাশে ওড়ে, তখন নিষ্পলক দৃষ্টিতে পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। রাইসার মতে, পাখির খুনসুটি ও জলকেলির যে সৌন্দর্য, তা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, ‘সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই সবচেয়ে প্রিয় প্রাণীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাখি। পাখির প্রতি মমত্ববোধ এবং সংযোগ বাড়াতেই এই মেলার আয়োজন। পাখির অভয়ারণ্য নিশ্চিত করতে হলে সুন্দর এবং প্রয়োজনীয় পরিবেশ ধরে রাখতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাখির বসবাস উপযোগী পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। এ কারণে প্রতিবছর শীত মৌসুমে পরিব্রাজক পাখি নিয়মিতভাবে এখানকার জলাশয়ে আসে।’
উপাচার্য ষাট-সত্তর দশকের ঢাকার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘সেই সময়ে ঢাকা সবুজ ছিল। অনেক জলাশয় ছিল। সেখানেও পাখি আসত। পাখির ডাকে তখন ঘুম ভাঙত, পাখি আমাদের সময় শেখাত। এখন সেই ঢাকা নেই। জলাশয় ভরাট, ইট, পাথর, কংক্রিটের নানাবিধ কাজের মধ্য দিয়ে মানুষ সবুজ প্রকৃতি ও পাখপাখালির ঢাকার পরিবেশ নষ্ট করেছে।’
‘পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। পাখি থাকলে গাছ থাকবে, গাছ থাকলে ফুল থাকবে, ফল থাকবে। পাখিকে ভালোবাসলে পাখি আমাদের প্রকৃতিতে অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেবে।’
প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবু বলেন, ‘পাখিকে আমরা ভালোবাসি শুধু সৌন্দর্য ও গান গাওয়ার জন্য নয়। পাখি প্রকৃতিতে আমাদের জন্য বিশাল ভূমিকা রাখছে। পাখি দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বীজকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, বীজ থেকে গাছ হচ্ছে এবং সেই গাছই আমাদের অক্সিজেনের ভান্ডার।’
‘দুঃখের বিষয়, যে পাখি আমাদের উপকার করে, সেই পাখিকেই আমরা হত্যা করছি। পাখি শিকার করে মূলত আমরা নিজের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি। আমাদের প্রয়োজনে, বাঁচার তাগিদে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আমাদের পাখিকে রক্ষা করতে হবে। পাখি না থাকলে আমরাও একসময় হারিয়ে যাব।’


অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ড. শেখ মো. মঞ্জুরুল হক, আইইউসিএনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি রকিবুল আমিন, পাখিবিশারদ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক আখতার হোসেন এবং মেলার আহ্বায়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান।


মেলার দিনব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে ছিল আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পাখি দেখা প্রতিযোগিতা, পাখিবিষয়ক আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশু-কিশোরদের জন্য পাখির ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, টেলিস্কোপ ও বাইনোকুলার দিয়ে শিশু-কিশোরদের পাখি পর্যবেক্ষণ, স্টল সাজানো প্রতিযোগিতা (পাখির আলোকচিত্র ও পত্রপত্রিকা প্রদর্শনী), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পাখিবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন, আন্তবিশ্ববিদ্যালয় পাখি চেনা প্রতিযোগিতা (অডিও-ভিজ্যুয়ালের মাধ্যমে) এবং উপস্থিত সবার অংশগ্রহণে পাখিবিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা। সবশেষে পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী অনুষ্ঠান।

এ ছাড়া বাংলাদেশের পাখি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করায় শফিকুর রহমান শুভ্র, মো. কায়েস ও তৌকির হাসান হৃদয়কে ‘বিগ বার্ড বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড’, পাখিবিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রকাশ করায় মুনতাসির আকাশকে ‘সায়েন্টিফিক পাবলিকেশন অ্যাওয়ার্ড’ এবং পাখি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় সম্প্রচার মাধ্যম ক্যাটাগরিতে আবদুল্লাহ আল ওয়ালিদ, প্রিন্টে আদিব মুনিম আরিফ এবং অনলাইন ক্যাটাগরিতে রাহুল এম ইউসুফকে ‘কনজারভেশন মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করা হয়।