শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় দিনবদলের আকাঙ্ক্ষা

প্রভাষ আমিন
| আপডেট : ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৬ | প্রকাশিত : ১৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:০৫

কোনটা বেশি চমক জাগানো, নির্বাচনের ফল না মন্ত্রিসভা; এটা নিয়ে টস হতে পারে। নির্বাচনের ফলাফলের চমকটা অপ্রত্যাশিত, কিন্তু মন্ত্রিসভারটা পরিকল্পিত। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে দুটোই পিলে চমকানো। আগের মন্ত্রিসভার ৩৬ জনই বাদ, ৩১ জন নতুন, ২৭ জন একেবারেই নতুন; এই পরিসংখ্যান যতটা বিস্ময়কর, বাদপড়া নামগুলো তারে চেয়ে বেশি। আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, মতিয়া চৌধুরী, নুরুল ইসলাম নাহিদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কামরুল ইসলাম, শাজাহান খান- একের পর এক চমকের ঢেউ যেন। এবারের মন্ত্রিসভা শেখ হাসিনার সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্তের একটি। মন্ত্রিসভার দিকে তাকালে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস এখন তুঙ্গে; দল ও সরকারে তার নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্র। তুখোড় ফর্মে থাকা ক্রিকেটার যেমন ক্রিকেট বলকে ফুটবলের মতো দেখেন, ইয়র্কারেও ছক্কা মেরে দেন; রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনাও এখন তেমন- দল নিয়ে, মন্ত্রিসভা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন অনায়াসে।

শেখ হাসিনার এবারের মন্ত্রিসভা প্রায় নির্ভেজাল আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। এর আগে শেখ হাসিনার তিন মেয়াদের মন্ত্রিসভায় শরিক দলের প্রতিনিধি বা অন্য দল থেকে আসা নেতারাও ছিলেন। ১৯৯৬ সালের ঐকমত্যের সরকারে জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জেএসডির আ স ম আবদুর রব তো ছিলেনই, ছিলেন ন্যাপ থেকে আসা মতিয়া চৌধুরীও। ২০০৮ সালের পর গঠিত মহাজোট সরকারে জাতীয় পার্টি, সাম্যবাদী দল, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদের প্রতিনিধিরা তো ছিলেনই, ছিলেন ন্যাপ থেকে আসা মতিয়া চৌধুরী, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে আসা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সিপিবি থেকে আসা নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুল মান্নান খান, জাসদ থেকে আসা শাজাহান খানরাও। ২০১৪ সালের সরকারেও তাদের অনেকে ছিলেন। তবে এই প্রথম শেখ হাসিনার অধীনে প্রায় নির্ভেজাল আওয়ামী লীগের একটি মন্ত্রিসভা শপথ নিলো। টেকনোক্র্যাট কোটায় জাসদ থেকে আসা মোস্তাফা জব্বার ছাড়া আর কোনো ভেজাল নেই। এবারের মন্ত্রিসভা আত্মীয়-স্বজনমুক্ত। এমনকি এই প্রথম জাতীয় চার নেতার পরিবারের কেউও নেই মন্ত্রিসভায়।

শেখ হাসিনার এবারের মন্ত্রিসভায় দল আর সরকারকে আলাদা রাখার একটা চেষ্টা আছে। আওয়ামী লীগের ৩৮ সদস্যের উপদেষ্টামণ্ডলী আর ৮৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এই মোট ১২১ জনের মধ্যে মাত্র ১৪ জন আছেন ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভায়। ৩৮ সদস্যের উপদেষ্টামণ্ডলীর একমাত্র স্থপতি ইয়াফেস ওসমানই টিকেছেন মন্ত্রিসভায়। ২০০৮ সালের পর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ঢুকে এখন তিনি পরপর দুই সরকারের টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী। শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদের ছাড়া আর ড. আবদুর রাজ্জাকই মন্ত্রিসভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর প্রতিনিধিত্ব করবেন। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ড. হাছান মাহমুদ, শ ম রেজাউল করিম, টিপু মুনশি, শেখ মো. আবদুল্লাহও আছেন, আছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল মজিদ হুমায়ুন ও মুন্নুজান সুফিয়ান। তিন তরুণ সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এনামুল হক শামীম আর মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের বার্তা নিয়ে উপস্থিত থাকবেন। দলের বড় নেতা মানেই বড় মন্ত্রী, এই ধারণা এবার ভেঙেচুরে গেল। ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট সরকারের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠন না সরকার, এমন অপশনে সংগঠন বেছে নিয়েছিলেন। পদত্যাগ করেছিলেন মন্ত্রিসভা থেকে। তার কন্যা শেখ হাসিনা কি পরিকল্পিতভাবেই দল আর সরকার আলাদা রাখতে চাইছেন? রাখতে পারলে সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো, সরকারের জন্যও ভালো। সরকারের পেটে ঢুকে গেলে প্রাণ হারায় সংগঠন। আর আওয়ামী লীগ বারবার নানা বিপর্যয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তৃণমূলে বিস্তৃত সাংগঠনিক শক্তিকে পুঁজি করেই। সরকার সাময়িক, সংগঠন চিরস্থায়ী। সংগঠন ঠিক থাকলে আপনি অনেক কিছুই করতে পারবেন। মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়াকে ওবায়দুল কাদের ঠিক বাদপড়া বলতে রাজি নন। তার মতে, দায়িত্বের পরিবর্তন হয়েছে কেবল। এত দিন যারা শেখ হাসিনার এবারের মন্ত্রিসভায় দিনবদলের সাহসী ইঙ্গিত রয়েছে। সত্যি গত ১০ বছরের সরকারে যারা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত, সমালোচিত; তারা কেউ এবার নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় বারবার জনআবেগের বিপরীতে অবস্থান নেওয়া শাজাহান খান সবাইকে খুশি করে বিদায় নিয়েছেন। গম কেলেংকারির কারণে সমালোচনার মুখে পড়া অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ নুরুল ইসলাম নাহিদরা এবার বাদ পড়েছেন। এমনকি কথায় কথায় এ এম এ মুহিতের ‘রাবিশ’ গালিও আর জাতিকে শুনতে হবে না। তবে তিনি নির্বাচন না করে আগেই অবসরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন।

সমালোচিতরা যেমন বাদ পড়েছেন, তেমনি পারফরম্যান্সের মূল্যায়ন হয়েছে। সম্ভবত আসাদুজ্জামান খান কামাল একমাত্র স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বড় কোনো বিতর্ক ছাড়াই মেয়াদ পূরণ করেছেন। মতিন চৌধুরী, আলতাফ চৌধুরী, বাবর, নাসিম, সাহারা, মখা- দল নির্বিশেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানেই বিতর্ক। তাই মুক্তিযোদ্ধা আসাদুজ্জামান খান কামালকে নিয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। বহাল আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, আরো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পেয়েছেন লোটাস কামাল। নীরবে কাজ করে প্রমোশন পেয়েছেন এম এ মান্নান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, জাহিদ মালেক স্বপন, নুরুজ্জামান আহমেদ, বীর বাহাদুররা।

মন্ত্রিসভায় কাকে রাখবেন, কাকে বাদ দেবেন, সেটা শেখ হাসিনার একক এখতিয়ার। এবার মন্ত্রিসভায় সাইক্লোন বইয়ে দেওয়ার নানান তরিকা আছে। বিতর্কিতদের তো বিদায় দেওয়া হয়েছেই, কয়েকজন বাদ পড়েছেন স্রেফ বয়সের কারণে। যেমন ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, শামসুর রহমান শরিফ, মতিউর রহমান। আগের মন্ত্রিসভার সিনিয়র মোস্ট সদস্য এ এম এ মুহিত তো অবসরেই গেছেন। শাহজাহান কামাল, মুজিবুল হকের মতো অনেকে বাদ পড়েছেন পারফরম্যান্সের কারণে। তবে আমু, তোফায়েল, নাসিমের মতো হেভিওয়েট আর মতিয়া, নূরের মতো সফল মন্ত্রীদের বাদ পড়াটা আসলে অন্য ইঙ্গিত দেয়। এটা স্পষ্টতই দিনবদলের ইঙ্গিত, রাজনীতিতে নতুনদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বাদপড়া মানেই কিন্তু ব্যর্থতা নয়। শেখ হাসিনাও এটা বলেছেন। কাউকে বাদ দেওয়া মানে হয়তো তিনি তার সামর্থ্যের চূড়াটা ছুঁয়ে ফেলেছেন। নতুন কেউ হয়তো নতুন ভাবনা দিয়ে, নতুন চিন্তা দিয়ে নতুন কিছু করে দেখাতে পারবেন। যেমন মতিয়া চৌধুরী নিঃসন্দেহে দেশের সেরা কৃষিমন্ত্রী। কিন্তু কৃষিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক হয়তো নতুন কোনো চমক নিয়ে হাজির হবেন। আমার কাছে তাই নতুন মন্ত্রিসভা দিনবদলের আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। তবে অভিজ্ঞদের কাজে লাগানোর সুযোগ রয়ে গেছে। তোফায়েল আহমেদের মতো ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান সুযোগ পেলে সংসদ উপনেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। অন্যরাও দলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।

আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারের মূলসুর ছিল তারুণ্যের শক্তি। আর সেই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের জয়গান। সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, নসরুল হামিদ বিপু, শাহরিয়ার আলম, জুনাইদ আহমেদ পলকরা বয়সে এখনো নবীন, কিন্তু তাদের ঝুলিতে পাঁচ বছরের সাফল্য ও অভিজ্ঞতা। এবার তারা দায়িত্ব পালনে আরো আত্মবিশ্বাসী হবেন। তাদের সঙ্গে এবার যুক্ত হচ্ছেন জাহিদ আহসান রাসেল, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ফরহাদ হোসেন, ডা. মুরাদ হাসান, ডা. এনামুর রহমান, এনামুল হক শামীম, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলরা। তার মানে মন্ত্রিসভায় আমরা বেশি করে শুনব নতুন প্রজন্মের কণ্ঠ। অনেকে আড়ালে-আবডালে কচিকাঁচার আসর বলে টিকা-টিপ্পনী কাটছেন, কিন্তু মেধাবী তারুণ্যেই তো আমাদের আশা, আমাদের স্বপ্ন। সমাজের সব ক্ষেত্রে তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন, রাজনীতিতে কেন নয়? বয়সে নবীন না হলেও শ ম রেজাউল, টিপু মুনশি, গোলাম দস্তগীর গাজী, নুরুল মজিদ হুমায়ুন, এ কে আবদুল মোমেন, শাহাবউদ্দিনদের ভাবনায় নিশ্চয়ই ফ্রেশনেস থাকবে। আর নবীন ও নতুনদের অভিভাবক হিসেবে ফিরে এসেছেন ড. রাজ্জাক, ডা. দীপু মনি, ড. হাছান মাহমুদরা।

শপথ নেওয়ার পরের দুদিন পিকনিক মুডে ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে এসি বাসে চড়ে মন্ত্রিসভার সদস্যরা সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও টুঙ্গিপাড়ায় গেছেন। ৪৬টি গাড়ি একসঙ্গে মুভ করার চেয়ে চারটি বাসে যাওয়া অনেক বেশি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব। তারচেয়ে বড় কথা পুরো মন্ত্রিসভা একসঙ্গে বাসে চড়ে কোথাও যাচ্ছে- বিষয়টার মধ্যে যে উষ্ণতা, আন্তরিকতা আছে, তা আগামী দিনে তাদের অনেক কাজ অনেক সহজ করে দেবে। তবে মন্ত্রীরা যত দ্রুত পিকনিক মুড ঝেড়ে ফেলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তিনি তাদের কাজে নজর রাখবেন। দেশবাসীও বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে মন্ত্রিসভার দিকে নজর রাখবে।

প্রভাষ আমিন: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :