সিটিং বাস আগের মতোই পকেট কাটার ফাঁদ

প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:১২ | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৪৯

এম গোলাম মোস্তফা

নিউ ভিশনের একটি বাসে পল্টন থেকে কারওয়ান বাজারে যাচ্ছিলেন জিয়াউদ্দিন। সুপারভাইজার ভাড়া চাইলেন ১৫ টাকা। ১০ টাকায় নিত্যদিন চলাচল করেন জানালে সিটিং সার্ভিসের লোগো দেখিয়ে দেন ভাড়া তোলা শ্রমিক। অথচ ওই সময়েও বাসে পাঁচ-ছয়জন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ভাড়া বেশি চাওয়ায় বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে শাহবাগের যানজটে বাস থামিয়ে ওই যাত্রীর সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করেন বাসের সুপারভাইজার ও চালকের সহকারী।

নিউ ভিশনের এই চিত্র প্রায় প্রতিটি রুটে প্রতিনিয়ত ঘটছে। সিটিং সার্ভিসের নামে নৈরাজ্য চলছে নগরজুড়ে। নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতেই এভাবে সিটিং নামে গাড়ি চালায়, তবে ঠেসে ওঠানো হয় যাত্রী।

সিটিং সার্ভিস বলে আলাদা কোনো সার্ভিস নেই আইনে। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের কৌশল হিসেবে রাজধানীতে বাসমালিকেরা এই সেবা চালু করে নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ, কখনো তিনগুণ বা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছেন।
২০১৭ সালের মে মাসে বিআরটিএ এভাবে অবৈধভাবে সিটিং হিসেবে বাস চলা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু মালিকেরা পাল্টা কৌশল নিয়ে বাসের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া, যাত্রীদের ‘শায়েস্তা করতে’ বাসে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, মোড়ে মোড়ে অযথা বিলম্বসহ নানা কৌশল নেন। এক সপ্তাহ এভাবে চলার পর অভিযান বন্ধ করে বিআরটিএ।

তখন তিন মাসের মধ্যে নীতিমালা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের শেষ দিকে হুলুস্থুলের পর ওই বছরের ২৫ অক্টোবর এক মাসের মধ্যে সিটিং সার্ভিসের নীতিমালা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে প্রায় ৬৫ সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, আসেনি সেই নীতিমালা। আর এই সুযোগে যাত্রী হয়রানি আর পকেট কাটা চলছেই।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ৩ মে সিটিং সার্ভিসের নৈরাজ্য নিরসনে ‘সিটিং সার্ভিসসহ সুষ্ঠু যাত্রীসেবা’ নামে আট সদস্যের কমিটি করা হয়।

বিআরটিএর পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানীকে প্রধান করে পেশাজীবীদের সমন্বয়ে এই কমিটিকে গত বছরের জুলাইয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়ে গত বছরের নভেম্বরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এই কমিটি। এতে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কমিটি ১০টি সুপারিশ করলেও তার বাস্তবায়নে নজর নেই।

ওই কমিটিতে কাজ করা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেছেন, ‘বাসমালিকেরা কতটা শক্তিশালী, সেটা তারা দেখিয়ে দিয়েছেন। রাজধানীতে গণপরিবহন-ব্যবস্থায় সরকারি সংস্থার ভূমিকা সীমিত। এই অবস্থায় বাসমালিকেরা আইন মানতে চান না। কাজেই এই নীতিমালার কী হবে আর হলেও বাসমালিকেরা কতটা মানবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।’

জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক শেখ মাহবুব ই রব্বানী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা একটি গাইডলাইন পাঠিয়ে দিয়েছি। সেখানে সিটিং সার্ভিস চালু রাখার সুপারিশ করেছি। তবে সে ক্ষেত্রে সিটিং ও নন-সিটিং গাড়ির রং আলাদা করতে হবে। মানুষ যেন দূর থেকে দেখলেই বুঝতে পারে গাড়ি সিটিং কি না। পাশাপাশি সিটিং সার্ভিসের ভাড়া ও রুট নির্ধারণ করতে হবে।’

সুপারিশ কবে বাস্তবায়িত হবে এমন প্রশ্নে রব্বানী বলেন, ‘বিআরটিএর কাছে আমরা সুপারিশ করেছি। কিন্তু সিদ্ধান্ত কবে নেওয়া হবে এবং কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, তা আমার জানা নেই। এ জন্য আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালো বলতে পারবেন।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিসের এই নীতিমালা নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এই যে নীতিমালাই বলেন, নিয়মকানুন বলেন আর আইনকানুন যাই বলেন দিন শেষে সব সুবিধা মালিকদের দিকেই যাচ্ছে।’

‘কমিটিতে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। তখনই বুঝলাম এটা নিয়ে একটা তামাশা করা হচ্ছে। সিটিং সার্ভিসের নামে মালিকদের সুবিধা করা হচ্ছে। এতে করে জনসাধারণের শান্তি আসবে না এবং সরকারও ভবিষ্যতে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে।’

পরিবহন মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সিটিং সার্ভিস নীতিমালার সুপারিশ আরটিসিতে পাঠানো হয়েছে। এটা এখন তাদের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, আমাদের হাতে আর নেই। তারা অনুমোদন দিলে বাস্তবায়ন শুরু হবে।’

‘শুধু নেগেটিভ বললে হবে না, সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমরাও চাই রাজধানীর বাসগুলো কমফোর্টেবল হোক, সে ক্ষেত্রে ভাড়াও সমন্বয় করা হোক। তাতে আমাদের আপত্তি নেই।’
সব রুটে নিত্যদিন ঠকে যাচ্ছেন যাত্রীরা

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে লোকাল এবং গেটলক সিটিং নামে দুই ধরনের বাসসেবা চালু আছে। লোকাল বাস সব জায়গায় দাঁড়াবে এবং আসনের বেশি যাত্রী উঠবে আর গেটলকে এটা হবে না এটাই হওয়ার কথা ছিল চিত্র। তবে হাতে গোনা দু-একটি বাস আছে, যারা সব জায়গায় দাঁড়ায় না আর আসনের বেশি যাত্রী তোলে না।

গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ পর্যন্ত চলাচলকারী বলাকা পরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী তোলার কথা নয়। ভাড়াটাও সেভাবে নির্ধারণ করা। সিটিং সার্ভিস করার পর ভাড়া বাড়িয়ে কয়েক দিন যাত্রীসেবার মান ছিল ভালো। কিন্তু এখন অবস্থা যাচ্ছেতাই।

প্রতিটি আসনে যাত্রী থাকার পরও প্রায় প্রতিটি স্টপেজেই যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি করেন চালকের সহকারীরা। আর যাত্রীরা নিত্যদিন করেন ঝগড়া। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই চালকদের।

ব্যাংককর্মী ফাহিম ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার সময় ধাক্কাধাক্কি করে বাসে উঠতে হয়। আগে যেসব বাস হাত তুললে দাঁড়াত, সেগুলো এখন সিটিংয়ে রূপান্তরের কারণে আর দাঁড়ায় না। বিকেলে বাসায় ফেরার সময়ের কষ্টটা আরও অসহ্য।’

মিরপুর থেকে গুলিস্থান ও মতিঝিলে চলাচলকারী ল্যামস পরিবহন, হাজি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড, খাজা বাবা পরিবহন লিমিটেড, ইটিসি ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও বিকল্প অটো সার্ভিস লিমিটেডের বাসগুলোও সিটিংয়ের নামে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে কমলাপুর, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এবং মোহাম্মদপুর থেকে সায়েদাবাদে চলাচলকারী আয়াত পরিবহন, হিমাচল পরিবহন, নবকলি পরিবহন, মেশকাত ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড ও এভারেস্ট পরিবহনের।