সরেজমিন

পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি ও থানার ডায়েরি হয় মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে!

মহিউদ্দিন মাহী
| আপডেট : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:০১ | প্রকাশিত : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:৪৬

হাসিবুল ইসলাম ঢাকার একটি কলেজে সম্মান শ্রেণিতে পড়ছেন। তার দাখিলের সনদটি হারিয়ে গেছে। সনদের কপি তুলতে গিয়েছিলেন রাজধানীর বকশীবাজারে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে। সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, সনদ নিতে তাকে এক হাজার ৫২৩ টাকা দিতে হবে।

এর মধ্যে সনদের অনুলিপি ফি ৫২৩ টাকা। পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞাপন খরচ ৫০০ টাকা। আর থানায় সাধারণ ডায়েরি করার খরচ ৫০০ টাকা।

পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এবং সাধারণ ডায়েরির জন্য টাকা কেন বোর্ডকে দিতে হবে? জবাবে হাসিবুল ইসলাম বলেন, ‘কেন জানি না। এখানে একজন লোক বলেছেন টাকা দিলে আর কিছুই করতে হবে না। তিন দিন পর আসলে সনদ পাওয়া যাবে। সবকিছু তিনিই করে দেবেন।’

এই ব্যক্তিটি কে? জানতে চাইলে হাসিবুল ইসলাম আঙুল ইশারা করে একজনকে দেখিয়ে দেন। শিক্ষা বোর্ডের ভেতরে ঢুকতেই হাতের বাঁ-পাশে টেবিলে বসে আছেন লোকটি। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন অন্যরা।

গত বৃহস্পতিবার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে গেলে এমন চিত্র চোখে পড়ে। মূল ভবনের ঠিক সামনেই টিনের ছাউনির নিচে টেবিল। সেদিকে এগোতে শোনা গেল, টেবিলের ওপাশের চেয়ারে বসা লোকটি আগতদের কার কী কাজ জানতে চাইছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই ব্যক্তির নাম আসাদ। আগতদের কাছে তিনি শিক্ষা বোর্ডের ‘কর্মকর্তা’ বলেই পরিচিত।

তবে বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আসাদ বোর্ডের কিছুই না। তিনি ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়েন। এখানে যারা সেবা নিতে আসেন, তাদের কাজ করে দেওয়ার দায়িত্ব নেন তিনি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, সাধারণ ডায়েরি সব করে দেন। বিনিময়ে টাকা নেন। তার সঙ্গে বোর্ডের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর আর্থিক বিনিময়ের সম্পর্ক আছে।’

শুধু সনদের অনুলিপিই নয়, তথ্য সংশোধন, নম্বরপত্র তোলাসহ নানা কাজের জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীদের। সরাসরি কোনো কাজ করতে গেলে এই টেবিল সেই টেবিল ঘুরতে হয় তাদের। ঝামেলা এড়াতে আসাদের মতো লোকদের কাছে ধরনা দেন তারা।

এই প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে আসাদের সঙ্গে কথা বলেন। নম্বরপত্র হারিয়ে গেলে কী করতে হবে, জানতে চাইলে আসাদ বলেন, ‘কোনো সমস্যা নাই। আপনি একটা ফরম নেন। পূরণ করে জমা দেন। দেড় হাজার টাকা লাগবে। জমা দেওয়ার তিন দিনের মধ্যে নম্বরপত্র পাবেন।’

আসাদ যে ফরমটি সেবাগ্রহিতাকে দিচ্ছেন তার বিনিময়ে নিচ্ছেন ১০ টাকা। অথচ এটি ফটোকপির করতে লাগে দুই টাকা। আবার তথ্য সংশোধন, হারানো সনদপত্র, নম্বরপত্র তোলার জন্য সরকার নির্ধারিত ফির চেয়েও অতিরিক্ত টাকা নেন। কাজ যত জটিলই হোক, টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে সহজেই করে দেন তিনি।

যশোর থেকে এসেছেন মনিরুল ইসলাম। তিনি সনদপত্রের নাম সংশোধন করবেন। তার কাছ থেকেও কাজের জন্য দেড় হাজার টাকা নিয়েছেন আসাদ।

মনিরুল এই প্রতিবেদককে জানান, আসাদের কাছে আসার আগে তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, নাম সংশোধন করতে হলে তার বেশ কিছু কাজ করতে হবে। নোটারি পাবলিকে অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে তার নাম সংশোধন করতে হবে। তারপর সেটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে হবে। পরে এসব কাগজপত্রসহ নির্ধারিত ফরমে আবেদন করলে বোর্ড নাম সংশোধন করে দেবে।

মনিরুল জানান, যশোর থেকে তিনি সরাসরি বোর্ডে এসেছেন। ঢাকায় তার থাকার জায়গা নেই। কিন্তু বোর্ড থেকে যেসব কাজ করতে বলা হয়েছে, তা করতে গেলে কমপক্ষে তিন দিন ঢাকায় থাকতে হবে। এটি তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে তিনি বোর্ডের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে, তিনি আসাদকে দেখিয়ে দেন। বলেন, ‘তার কাছে যান। টাকা হলে আসাদের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই।’

মনিরুল বলেন, ‘উপায় নেই। টাকা দিলেও যদি ঝামেলামুক্তভাবে কাজটা হয়, তাতেই খুশি।’

নিজের কাজকে আসাদ ‘বোর্ডকে সহযোগিতার’ অংশ হিসেবে দেখছেন। এখানে চাকরি না করেও কীভাবে এখানে টেবিল পেতে বসেছেন? আলাপকালে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার সমস্যা কী? কাজ থাকলে বলেন। না থাকলে বিরক্ত কইরেন না।’

প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে আসাদের মতো এমন অনেকেই আছেন, যারা টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পর্ক আছে। কাজের বিনিময়ে যাদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেন তারা। অনেক ক্ষেত্রে এরা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চেয়েও বেশি প্রভাবশালী। তাদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেন না। দিনের পর দিন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই সেবাপ্রত্যাশীদের পকেট কাটছেন তারা। তবে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এফ ছায়েফউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি তা ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া মেলেনি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :