সঙ্গীসহ গ্রেপ্তার

সাইফুলের নাটকীয় প্রতারণার কাহিনি

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৩২

নিজস্ব প্রতিবেদক

জানুয়ারির শুরুর দিকের কথা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সিরিয়াস ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মীর মোদাচ্ছের হোসেনের কাছে এক প্রতারক চক্রের অভিযোগ আসে। অপরাধীদের ধরতে তিনি দায়িত্ব দেন একই বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার নাজমুল হককে। চৌকস এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার নেতৃত্বে ‘অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন টিম’ ১৫ জানুয়ারি শুরু করে অভিযান। সাতজনের সাঁড়াশি অভিযানে ধরা পড়ে প্রতারক চক্রের দুই সদস্য।
প্রতারণার অভিনব ফাঁদ পেতেছিল চক্রটি। সেই বাস্তব ঘটনা জানালেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাজমুল হক। তার বয়ানে শোনা ঘটনা সাজানো যায় এভাবেÑ শফিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম) একজন ব্যবসায়ী। আবু নামে তার এক বন্ধু থাকেন আমেরিকায়। হঠাৎ করে শফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে ফোন করলেন এক ব্যক্তি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমি তোমার বন্ধু আবু। আমেরিকা থেকে কিছুদিন আগে দেশে এসেছি।’

শফিকুলও অনেক দিন পর প্রবাসফেরত বন্ধুর ফোন পেয়ে দারুণ খুশি। আগ্রহ নিয়েই কথা বলতে থাকেন। এ পর্যায়ে এসে আবু তার কাছে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে এক লাখ টাকা ধার চান। বন্ধুর বিপদের কথা ভেবে শফিকুল এক লাখ টাকার ব্যবস্থা করেন।

এর পরদিন আবু নামের ওই ব্যক্তি আবার ফোন করলেন শফিকুলকে। তখন বললেন, ‘দোস্ত, মা তো মারা গেছেন। আরও এক লাখ টাকা প্রয়োজন।’ বন্ধুর এমন বিপদে কে না পাশে থাকে। শফিকুল না ভেবেচিন্তেই আরও এক লাখ টাকা আবুকে দিলেন।
দিন গড়ায়। পরদিন আবার আবুর ফোন। এবার মায়ের কুলখানির কথা বলে এক লাখ টাকাই চান তিনি। সরল মনে সেই টাকাও দেন শফিকুল। এরপর আবার ‘হাত খালি’র বাহানায় টাকা চান আবু। মনের মধ্যে খটকা বাড়তে থাকে শফিকুলের।

এবার তিনি আবুর আমেরিকার নম্বর ম্যানেজ করে ফোন দেন। তখন আবু বলেন, ‘আমি তো আমেরিকায়। গত পাঁচ বছরেও দেশে যাইনি।’ এই কথা শুনে শফিকুলের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন।

অভিযোগ নিয়ে শফিকুল যান পুলিশের কাছে। তারা অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারও করে। পুলিশ জানায়, নকল ‘আবু’র প্রকৃত নাম সাইফুল ইসলাম ওরফে দুর্জয়। তিনি ‘জীনের বাদশা’ নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেও বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ পেয়েছে আরও অনেক তথ্য। ২০ বছর বয়সী এই সাইফুল পাঁচ বছর ধরে নানা  উপায়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে। কখনো বন্ধু, কখনো আত্মীয়, কখনো আধ্যাত্মিক গুরু- এ ধরনের পরিচয় ব্যবহার করে তিনি মোবাইলের মাধ্যমে ধনীদের সম্মোহিত করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এবার তাকে গ্রেপ্তার করার অভিযানে যে কৌশল নেওয়া হয়, তা-ও নাটকীয়তায় ভরপুর। সেই ঘটনাও জানা গেল পুলিশ সূত্রেই। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে তারা প্রথমে অভিযুক্ত সাইফুলের অবস্থান শনাক্ত করে। ধূর্ত এই অপরাধী এক সিম বেশি সময় ব্যবহার করে না। তার কাছে অন্তত ২০টি সিম ছিল। এ কারণে তার অবস্থান নির্ণয় করাও ছিল দুরূহ। তবে হাল ছাড়েননি পুলিশ সদস্যরা। চেষ্টার পর চেষ্টায় সাইফুলের অবস্থান মেলে। তিনি তখন ছিলেন নিলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায়। সেখানে গিয়ে তাকে খুঁজতে থাকেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা। 

তারা ডোমারের দক্ষিণ আমবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান। সর্বশেষ যে বিকাশ এজেন্টের মাধ্যমে শফিকুলের কাছ থেকে টাকা নেয় সাইফুল, সেই এজেন্টের সন্ধান পাওয়া যায়। রাতে ওই বিকাশ এজেন্টের দোকানে যায় অভিযানকারীরা। তিনি জানান, লেনদেনকারীর নাম জানেন না, তবে দেখলে চিনবেন। এরপর বিভিন্ন কৌশলে সাইফুলের ছবি পাওয়া যায়, যা বিকাশ এজেন্ট সহজেই চিনতে পারে। এরপর সাইফুলের অবস্থান বের করতে আর দেরি হয় না। গ্রেপ্তার করা হয় সহযোগী সুজন সরকারসহ সাইফুলকে।

এ সময় তাদের কাছ থেকে আটটি মোবাইল সিম, একটি মোবাইল ফোনসেট ও ২০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনা শুনে এগিয়ে আসেন আরেক ভুক্তভোগী। রাশেদ আলম নামের এই ব্যক্তিও গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় প্রতারণার মামলা করেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত সাইফুল দোষ স্বীকার করে জানান, তার বিরুদ্ধে মাদক, প্রতারণা, অস্ত্র আইনে পাঁচটি মামলা রয়েছে। তিনি এর আগে ৯ মাস জেল খেটেছেন।