শেরপুরে উপজাতিদের খাবার পোশাক ভাষার কান্না

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৩:৪৪

শেরপুর প্রতিনিধি
ফাইল ছবি

শেরপুরের নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকাজুড়ে কোচ আর গারো উপজাতিরা বসবাস করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনমান বাড়লেও এ অঞ্চলের উপজাতিদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটেনি। বরং তাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। হারাতে বসেছে তাদের খাবার, পোশাক ও ভাষা।

ওই তিন উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ২০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে নয় হাজার উপজাতি পরিবারের বাস। ৭০ থেকে ৮০ হাজার উপজাতি সদস্য নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে এ অঞ্চলে বসবাস করছে।

উপজাতীদের অন্যতম হলো- গারো, হাজং ও কোচ সম্প্রদায়। তাদের রয়েছে আলাদা কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও আলাদা সমাজব্যবস্থা। গারোরা খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী, আর কোচ ও হাজং সম্প্রদায়ের লোকজন সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় উৎসব ছাড়াও এ দুই সম্প্রদায় আলাদা আলাদা আরও নানা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। 

নালিতাবাড়ীর ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন চেয়ারম্যান মি. লুইস নেংমিনজা বলেন, কালের বিবর্তনে বর্তমান ডিজিটাল যুগে গারো, হাজং ও কোচ উপজাতিদের হাজার বছরের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। 

ঝিনাইগাতীর ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নবেশ খকশি বলেন, নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে পানিহাটা, তাড়ানি, পেকামাড়ি, মায়াঘাসি, নাকুগাঁও, দাওধারা, আন্ধারুপাড়া, খলচান্দা, বুরুঙ্গা, বাতকুঁচি, সমেশ্চুড়া, খলিসাকুঁড়ি, গাছগড়া, নয়াবিল; ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া, গান্ধিগাঁও, নকশি, বাকাকুঁড়া, পানবর, গুরুচরণ দুধনই, সন্ধাকুঁড়া, মরিয়মনগর, ডেফলাই ও জারুলতলা।

এ ছাড়া শ্রীবরদীর বাবলাকোনা, হারিয়াকোনা, ঢিগলাকোনা, চান্দাপাড়া, মালাকোচা, ঝুলগাঁও, খ্রীস্টানপাড়া, কোচপাড়া, খারামোরা, বালিজুড়ি, অফিসপাড়া, বকুলপাড়া, উত্তর হারিয়াকোনা, দক্ষিণ হারিয়াকোনা ও মেঘাদল এলাকায় কোচ ও গারো উপজাতীদের বসবাস। 

সময়ের সঙ্গে আর সব মানুষের জীবনমান বাড়লেও উপজাতিদের ভাগ্যের কোনো উন্নয়ন ঘটেনি বলে মনে করেন আদিবাসী নেতা প্রদীপ জেংচাম। বরং তাদের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। এই হারানোর মিছিলে আছে বাদ্যযন্ত্র, খাবার, পোশাক, এমনকি ভাষাও। প্রদীপের তথ্যমতে, বিলুপ্তি হয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে (উপজাতীদের ভাষায়) মান্দিদামা, ক্রাম, খোল, নাগ্রা, জিপসি, খক, মিল্টাম, স্ফি, রাং, বাঁশের বাঁশি, আদুরী নামের বাদ্যযন্ত্র।

আর পোশাকের মধ্যে দকবান্দা, দকশাড়ী, খকাশিল, দমী, রিক মাচুল, আর কোচ উপজাতীদের রাঙ্গা লেফেন ও আছাম হারিয়ে যেতে বসেছে। 

খাদ্যের তালিকায় থাকা বাঁশের কড়–ল আর চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি খাবার উপকরণ ‘মিয়া’, কলাপাতায় করে ছোট মাছ পোড়া দিয়ে খাওয়া যার নাম ‘ইথিবা’, মুরগির বাচ্চা পোড়া দিয়ে বাঁশের চোঙ্গায় ভরে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ দিয়ে ভর্তা করে খাওয়া যার নাম ব্রেংআ; মিমিল, কাঁকড়া, শামুক ও শূকরের মাংস, চালের তৈরি মদ যার নাম চু, আর কোচ উপজাতীদের কাঠমুড়ি খাবার এখন আর নেই বললেই চলে। 

খলচান্দা গ্রামের পরিমল কোচ বলেন, ‘আমরা পাহাড়ে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে অসহায় জীবন যাপন করে আসছি। তাই পেটের তাগিদে ইতিহাস-ঐতিহ্য বুঝি না, শুধু বুঝি বেঁচে থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, নিজস্ব ভাষায় কথা বলার জন্য কোচদের আছে ‘কোচ’ ভাষা আর গারোদের আছে ‘আচিক’ ভাষা। বর্তমানে এই দুই ভাষাতেও বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই তাদের নিজস্ব ভাষার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা জুড়ে দিয়ে কথা বলে। 
ঝিনাইগাতীর রাংটিয়া কোচপাড়া গ্রামের রমেশ চন্দ্র কোচ বলেন, কোচ ভাষায় এখন বাংলা ভাষার মিশ্রণ ঘটে গেছে। এমনকি তিনি নিজেও তাদের নিজস্ব ভাষার সঙ্গে বাংলা যোগ করা ছাড়া কথা বলতে পারেন না। ‘আমরা অনেক দুঃখ-কষ্ট নিয়ে পাহাড়ে জীবন যাপন করি’ এই কথাটি কোচ ভাষায় জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদকের সামনে তা বলতে পারেননি তিনি। 

উপজাতীদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি সংরক্ষণে শেরপুরের উপজাতি অধ্যুষিত তিন উপজেলায় কালচারাল একাডেমি স্থাপন, নিজেদের ভাষা সংরক্ষণ তথা মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য উপজাতিদের ভাষাশিক্ষা স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কাছে  দাবি জানান শ্রীবরদী উপজেলা ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান প্রাঞ্জল এম সাংমা।