তৃতীয় অধ্যায় !

জাকির হোসেন সেলিম
 | প্রকাশিত : ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১৭:২৬

নীলা বলতো টুনাটুনির সংসার ।

আজ এই টুনাটুনির সংসার ভাঙ্গছে ।

আকাশ-নীলা লেখা একটা কাগজ কম্পিউটার টেবিলে সাঁটা ছিল, আঠার টেমপার কমে গেছে, কাগজটা এখন মেঝেতে লুটাচ্ছে । মানুষের জীবনটাও এমনি, প্রতিটি সম্পর্কের শুরুতে একটা শক্ত বাঁধন থাকে, ক্রমে তা শিথিল হতে থাকে, এক সময় আলাদা হয়ে যায় । সবাই হয়তো আলাদা হয় না, কেউ কেউ আধা খসে যাওয়া কাগজের টুকরার মতো লটকে থাকে; বাতাসে এদিক-ওদিক দোলে । তবে প্রকৃতির নিয়মেই কখনও কখনও সামান্য আঠা সুপারগ্লু হয়ে উঠতে পারে । কেন এমন হয়, আকাশের তা জানা নাই । আকাশ এই মূহুর্তে বদ্ধ ফ্ল্যাটে ঘামছে, মে মাসের গরম; সকাল হতেই সূর্য্য যেন তাপ ঢেলে দিতে শুরু করেছে ।

আকাশের আরামবাগের ফ্ল্যাটে থাকার বয়স হলো সাড়ে চার বৎসর, নির্দিষ্ট করে বললে সামান্য কয়েকদিন বেশীই হবে । ফ্ল্যাটটা ছিল আকাশ-নীলার টুনাটুনির সংসার । এখন টুনা আছে, টুনী নাই । আকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যায় । সে তাদের দেড় রুমের খালি ফ্ল্যাটটা দেখে । সব মালামাল নামানো হয়ে গেছে, তবুও আকাশ নীচে নামতে পারছে না, ফ্ল্যাটটার প্রতি কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে । কত স্হৃতি ! বাড়ির মালিক তৈমুর ভাই বার দু’য়ের খুঁজ নিয়ে গেছেন, নীলা কেন আসে নাই, জানতে চেয়েছেন । আকাশ কিছু বলে নাই, তার বলার কিছু নাই । আকাশ কি বলবে, তৈমুর ভাই,

আমার বৌ এর অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে গেছে ।

তৈমুর ভাই সকাল থেকে এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করেছেন, পরম আত্বীয়ের মতোই দায়িত্ব পালন করে গেছেন, কোন অবহেলা করেন নাই । ইমতি, তৈমুর ভাই এর ছোট মেয়ে,আকাশের পাশে ঘুর ঘুর করছে । সেও কিছু একটা বলতে চায়, বলছে না । ইমতি, আকাশের চোখে চোখ রাখছে না । আকাশ তার দিকে তাকাতেই অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে । আকাশের মনটাও আদ্র হয়ে আছে, সেও ইমতিকে ঘাটাতে চাচ্ছে না। হায়রে সংসার, ছয় বৎসরের ইমতির সাথে একজন যুবকের কি কথা থাকতে পারে? কিছু একটা বলার জন্য তবুও মনটা কেন এতো ছটফট করে ?

আরামবাগ খুবই গিন্জি এলাকা, না আবাসিক না বানিজ্যিক । এই ব্যাস্ত এলাকায় ফ্লটিং মানুষজনের আনাগুনা বেশী বলেই কেউ কারো খবর রাখে না ! একদিক দিয়ে ভালই, যারা নিজেদের আঁড়াল করতে চায়, তাদের বাড়তি প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয় না । এই ব্যাস্ত এলাকাতেই আকাশ, নীলাকে নিয়ে বাসার সন্ধানে এসেছিল । তারা দুই জনেরই তখন তৃতীয় বর্ষে পড়ে । আকাশের হলের সিট পাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল । গনরুম, ফ্লরিং; ডাবলিং; আকাশ নিজের মতো করে পড়াশুনা করতে পারছিল না । নীলারও সমস্যা হচ্ছিল, বাসা সাভারে, বাসে যাতায়াতই একমাত্র পথ । রোজ বাসা থেকে এসে ক্লাস করতে সমস্যা হচ্ছিল । মেয়েদের হলে সিট পাওয়া আরো সমস্যা, সে ফিলসফির এক মেয়ের সাথে বেড শেয়ার করছিল ।

নীলার বুদ্ধিতেই বাসা নেয়া । বাসার খরচ দুইজনেই সমান ভাবে শেয়ার করবে । বাসায় জানবে হলে আছে, হলে জানবে বাসায় আছে; তারা থাকবে আবামবাগে । সমস্যা যে হবে না, তা না; সমস্যা হলে দুই জনে মিলেই সমাধান করবে !আকাশ, নীলার প্রেমের শুরু দ্বিতীয় বর্ষ হতেই । এক বৎসর প্রেম করার পর তারা বুঝতে পারে পরম্পরকে ছাড়া তাদের জীবন অচল । তারা সম্পর্কটা আরো এগিয়ে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় । দুই জনেই পড়াশুনার ব্যাপারে ভীষন সিরিয়াস, এক সাথে থাকলে পড়াশুনার ব্যাপারেও পরস্পরকে সাহায্য করতে পারবে । আকাশ, নীলা, বিয়ের জন্য তৈরী না, বিয়ে করলে পরস্পরের প্রতি বাড়তি কিছু দায়িত্ব চলে আসে; পড়াশুনার ক্ষতি হতে পারে । সময় হলে তারা বিয়ে করবে, সমস্যা তো নাই ! বিয়ের সিদ্ধান্ত যেখানে পাকা, নিজেদের বন্চিত করে লাভ কি ?

আকাশ, নীলা স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে আরামবাগে বাসা নেয় । এক খাটের বাসা না । দেড় রুমের সাজানো ফ্ল্যাট । দুই জনেই সচ্ছল পরিবারের সন্তান, নিজেদের পছন্দের আসবাব পত্র দিয়ে বাসা ভর্তি করে ফেলে । বাড়িওয়ালাকে বলেছিল, প্রেমের বিয়ে; পরিবারকে এখনই জানাতে চাচ্ছে না । নীলা ফ্ল্যাটে অনিয়মিত, প্রথম কিছুদিন বাড়িওয়ালা বাঁকা চোখে তাকাতো । নীলা ধীরে ধীরে বাড়ীওয়ালার বৌ এর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে । সময় যেতে থাকে, এক সময় বাড়ীওয়ালার কৌতুহলও কমে যায় । নীলা অনিয়মিত হলেও, মাস শেষে ভাড়া নিয়মিতই আসে; এত শত ভেবে কি লাভ ! তাদের যৌথ জীবন ভাল চলছিল । আকাশ, নীলা বাড়িওয়ালার পরিবারেরই অংশ হয়ে যায় । নীলা এলেই ইমতি আসে, গুটি গুটি পায়ে ফ্ল্যাট জুড়ে হাঁটাহাঁটি করে । আকাশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ।

পরীক্ষার সময় নীলা বরাবর আকাশের সাথেই থাকে, উদ্দেশ্য পড়াশুনায় পরস্পরকে সাহায্য করা ।

ফাইনাল পরীক্ষার শেষে একটা সমস্যা দেখা দেয় । নীলা হঠাৎ অসুস্হ হয়ে পড়ে । আকাশ দ্রুত নীলাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় নীলা মা হতে চলেছে । আকাশের ভেতর আনন্দের বন্যা বয়ে গেলেও খবরটা নীলাকে মোটেই খুশী করতে পারে না । সে বার বার বলে,

আকাশ, আমাদের আরো সাবধান হওয়া দরকার ছিল । আরো সাবধান হওয়া দরকার ছিল । সে আবার জিজ্ঞেস করে,

বাচ্চাটা কি পরিচয়ে পৃথিবীতে আসবে ?

আমাদের পরিচয়ে পৃথিবীতে আসবে, আকাশ জোড় দিয়ে বলে । আমরা এখন নিজেদের সম্পর্কটাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দেব । আর মিথ্যা পরিচয় না, নীলা, আমরা বিয়ে করবো ।

শুনলে না, ডাক্তার কত সপ্তাহ বলেছে ?

তাতে কি হলো ? এখনই বিয়ে করলে না হয় সাত মাস পরেই আমাদের সন্তান আসবে, সমস্যা তো নাই !

আলোচনা আপাতত শেষ, নীলা হ্যাঁ, না, কিছুই বলে না; সারাদিন বিমর্ষ হয়ে থাকে । সন্ধ্যার পর তারা আবার পরস্পরের মুখোমুখি হয় । নীলা এখনি বাচ্চা না নেয়ার অনেক গুলো কারন দেখায় । এক সময় আকাশও নীলার মানসিক অবস্হাটা বুঝতে চেষ্টা করে । সে নীলার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোড় খাটায় না । আকাশ, হাসপাতালের খুঁজে বের হয়, খুঁজ নিয়ে জানতে পারে এব্রোশনের খরচ বাবদ দশ হাজার টাকার মতো লাগবে ।

আকাশ আবার নীলাকে বুঝাতে চেষ্টা করে ।

চল না, এই দশ হাজার টাকা দিয়েই শুরু করি ! ভাল কিছুও তো হতে পারে ? আর ডাক্তার বলেছে যথেষ্ট দেরীও হয়ে গেছে । তোমার নিজের জন্যও বিপদ হতে পারে ।

নীলা রেগে যায় ।

তুমি দশ হাজার টাকা নিয়া ভাবলে ? আমাদের ভবিষৎ নিয়ে ভাবলে না?

আকাশও রেগে যায় । সে আসলে নীলাকে বুঝাতেই টাকার বিষয়টা উল্লেখ করেছে । যে বিষয়টা তাদের জীবনে অভিসম্ভাবী,আকাশ সেই বিষয়টা মেনে নিতে চাচ্ছে । সমস্যা হলে দুইজনে মিলেই সমস্যার মোকাবেলা করবে । নীলা আকাশকে কেন ভুল বুঝবে ? আকাশ বলে,

আমি তো আমাদের ভবিষৎ নিয়েই ভাবছি । আমরা সাড়ে পাঁচ বৎসর পরস্পরের সাথে আছি । বিয়ে না করেও স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে এই বাসায় আছি । এখন পড়াশুনা শেষ, চাকুরী একটা হবে, তোমার হবে, না হয় আমার হবে, একজনের তো হবেই । পড়াশুনার চাপ নাই, এখন বিয়ে করতে সমস্যা কি ? আমরা আর কোন মিথ্যা পরিচয় বয়ে বেড়াব না । আলোচনার এই পর্যায়ে নীলা উঠে চলে যায় । নীলা ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে কিনা, আকাশ বুঝতে পারে না ।

দুই দিন নীলার কোন খুঁজ নাই । তার ফোন বন্ধ । নীলার পুরানো অভ্যাস, রাগ করলে ফোন বন্ধ করে রাখে । আকাশ নীলাকে নিয়ে খুব একটা ভাবে না । রাগ কমলে চলে আসবে । নীলা আসে তিনদিন পর । শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । নীলার সব কথা শুনে আকাশের শরীর একেবারে হীম হয়ে যায় । নীলা তাদের সন্তানকে নষ্ট করে ফেলেছে । মোহাম্মদপুরের এক ক্লিনিকে, খরচ হয়েছে মাত্র পনের’শ টাকা । নীলা এব্রোশনের যে বর্ননা দিল তা আরো ভয়াবহ ।

তারপর হতে জ্বর । আকাশের প্রচন্ড রাগ হয় । আবার এক ধরনের মায়াও অনুভব করে । নীলা তো তার কাছেই ফিরে এসেছে । এই সময়ে নীলা আর কোথায় যাবে ? আকাশ নিজেকেও ঘটনার জন্য সমান দায়ী ভাবে । আকাশ, নীলাকে এক গায়নী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় । ডাক্তার সব শুনে নীলাকে ঔষধ দেয়, বিষয়টা পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য কিছু টেস্ট করতে দেয় । আকাশ সেই দিনেই নীলার কিছু টেষ্ট করায়, বাকী টেষ্ট গুলো করায় দুই দিন পর । ঔষধ খাবার পর নীলার জ্বর কমে যায় । নীলা আবার সাভার চলে যায় । পরীক্ষা শেষ, হলে থাকার অজুহাত খুব কাজে আসে না ।

আকাশ নির্দিষ্ট দিনে টেষ্টের রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যায় । ডাক্তার রিপোর্ট গুলো দেখে জিজ্ঞেস,

আপনার স্ত্রী আসে নাই ।

না, হঠাৎ ও ঢাকার বাইরে গেছে ।

কত দিনের বিয়ে আপনাদের ।

চার বৎসর আমরা এক সাথে আছি ।

ডাক্তার আকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে । নিজের প্রশ্ন আর উত্তরের মাঝে কতটুকু ফাঁক আছে বুঝতে চেষ্টা করে । আপনি কিসে পড়াশুনা করেছেন ?

আমরা দুইজনেই ইংরেজীতে পড়াশুনা করেছি । আকাশ জবাব দেয় ।

ওনার ওভারিতে সামান্য ইনফেকশন ছিল, এখন আর নাই । আপনার বান্ধবী ভাল হয়ে গেছেন ।

তবে, আপনাকে একটু বলি, মাতৃগর্ভে একটা ভ্রুন ডেভলাপ করার জন্য পুরুষের শুক্রকীটের সাথে নারীর ডিম্বানুর মিলন ঘটতে হয় । সন্তান হবার জন্য অত্যাবর্শকীয় শর্ত ডিম্বানুর আধার আর উনার জরায়ুতে নাই । পুরো থলিটাই হারিয়ে গেছে । তিনি স্বাভাবিক নিয়মে আর সন্তান ধারন করতে পারবেন না ।

ডাক্তারের ম্যাসেজটা আকাশ ধরতে পেরেছে । হতাশায় তার মনটা ছেয়ে যায় । কেন এমন হলো বুঝতে পারে না ।

নীলা আর মা হতে পারবে না ।

নীলা বিষয়টা কি ভাবে নেবে ? আকাশ নীলাকে ব্যাপারটা বলবে কি না ভাবে । আকাশের নিজের কি কোন দায় নাই ? নীলা এব্রোশন করানোর আগে তার সাথে কথা বলে নাই, সে অন্যায় করেছে; তাই বলে আকাশ ব্যর্থতার পুরো দায় নীলার উপর চাপিয়ে দিতে পারেনা । তারা সারা জীবন এক সাথে থাকার ওয়াদা করেছিল । আকাশ ঠিক করে নীলাকে আপাতত কোন কথা জানাবে না, আর যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাজটা শেষ করে ফেলবে । বাসায় ফিরেই আকাশ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, কল্পনার চোখে দেখতে পায় ইমতি গুটিগুটি পায়ে সারা ঘর হাঁটছে ।

এইবার নীলা সাভার থেকে বেশ দেরী করে ফিরে । আকাশকে বলে, বাসাটা ছেড়ে দাও । আমি বোধ হয় খরচের ব্যাপারে তোমাকে আর সাহায্য করতে পারবো না । আকাশ ভাবছিল, নীলা রিপোর্ট গুলোর কথা জানতে চাইবে, ডাক্তারের সাথে কি কথা হয়েছে জানতে চাইবে । আকাশ বিষয়টাকে সিরিয়াসলি নেয় না, কয়দিন পর বিয়ে করলে তাদের থাকার জন্য বাসা তো লাগবেই । এই বাসার চেয়ে ভাল বাসা এফোর্ট না করা পর্যন্ত বাসা ছাড়ার প্রশ্নই আসে না । খরচের একটা ব্যবস্হা হয়ে যাবে । সে নীলার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত । নীলা পুরো ব্যাপারটা জানতে পারলে কি রকম রিয়েক্ট করবে বলা যাচ্ছে না । আকাশ একবার বলে, রিপোর্ট গুলো ডাক্তারকে দেখিয়েছি ।

আর রিপোর্ট দিয়ে কি হবে । জ্বর তো নাই । আমি ভাল হয়ে গেছি । নীলা জবাব দেয় ।

আকাশ আর কথা বাড়ায় না ।

নীলা সাভার থেকে ফেরার পর হলে উঠে । তাকে বেশ গম্ভীর লাগছিল । আকাশ হলে উঠার কারন জিজ্ঞাস করলেও নীলা কোন কারন বলে নাই । ফোনেও তেমন কথা হয় না, কোন প্রশ্ন করলে হ্যাঁ কিংবা না ধরনের উত্তর দেয় । আকাশকে বিয়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও কিছু জানায় নাই । মাস খানেকের হয়ে যায়, নীলা একবারও আরাগবাগের বাসায় আসে নাই ।ইমতি নীলাকে খুঁজে, বাড়ীওয়ালী নীলার ব্যাপারে জানতে চায় । আকাশ সবাইকে চাকুরী খুঁজার ব্যাস্ততার কথা বলে । সঠিক জবাব তো তার কাছেও নাই !

সময় মতোই রেজাল্ট হয় । আকাশের রেজাল্ট নীলার চেয়ে ভাল হয় । রেজাল্ট হবার তিন মাসের মধ্যেই নীলার চাকুরী হয়ে যায় । আকাশ পত্রিকার টেম্পরারি কাজটা নিয়েই থাকে । চাকুরী হবে হবে করেও হচ্ছে না । বিষয়টা রহস্যজনক । তার রেজাল্ট ভাল, তুখোড় বক্তা, বরাবর ডিবেটের মধ্যমনি; তারপরও চাকুরী হচ্ছে না । আকাশ এক দুপুরে নীলার অফিসে যায় । ঝমকালো অফিস । নীলা ছুটি নিয়ে আকাশের সাথে বের হয় । নীলাকে কেমন যেন নতুন নতুন লাগে । ঠিক বলে বুঝানো যাবে না, এই নীলাকে আকাশ চেনে না । আকাশ দুপুরের খাবার খেতে খেতে নীলাকে আবার বিয়ের কথা বলে ।

নীলা আকাশের কাছে জানতে চায়, বাসা কবে ছাড়বে । ভিন্ন প্রসঙ্গ ।

বাসা ছাড়ার দরকার কি ? তোমার অফিসের গাড়ী আছে, বিয়ের পর এখান থেকেই যেতে পারবে ।

নীলা বিরক্ত হয় । বলে,

মাত্র তো চাকুরী পেলাম । বাসায় তোমার ব্যাপারে কি বলব ? তোমার একটা চাকুরী হোক । আমরা কেউ তো চাপে নাই ।

আকাশ নিজের অবস্হাটা বুঝতে পারছে, তারপরও জিজ্ঞেস করে,

বাসায় বলার মতো কিছু কি বাকি আছে ?

মানে কি ? আকাশের প্রশ্নে নীলার বিরক্তি বাড়ছে ।

বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আমরা অনেক আগেই নিয়েছি, এখন দেরী করছি কেন? আকাশের সরল প্রশ্ন । বলে, বাই দ্যা ওয়ে,

আমরা বিয়ে করার বিকল্প কিছু কি ভাবছি ?

নীলা চকিত একবার আকাশের মুখের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় । আকাশের প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না । আকাশ, নীলার দৃষ্টিতে একটা রহস্যের ছায়া দেখে । সেই দিন কথা আর এগোয় না ।

সময় কত দ্রুত বদলায় ।

আজ আকাশ আবার নীলার অফিসে গিয়েছিল । নীলাকে দুই দিন ফোনে পাচ্ছিল না, ফোন বন্ধ । আকাশ নীলার খুঁজ নিতে গিয়েই বিয়ের কথাটা জানতে পারে । আকাশ নীলার সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসতেই নীলা দুই কাপ কফি দিতে বলে । কফি আসে, নীলা জানায় তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । ছেলে তাদের এলাকার । আকাশ কফির কাপ হাতে নিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকে । সে কফির কাপে ঠোঁটে ছোঁয়ায় না, বুঝতে চেষ্টা করে নীলা মজা করছে কি না । নীলাকে দেখে মনে হয় না সে মজা করছে ।

আকাশ কেন যেন খুব একটা অবাক হয় না । বিয়ে নিয়ে নীলার দ্বিধা বোধ হয় আকাশকে ভেতর থেকে তৈরী করে তুলেছে । সে শুধু জিজ্ঞেস করে,

তোমার হবু বরকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলেছ?

বলেছি । নীলা খুব স্বাভাবিক ভাবে কফির কাপে ঠোঁট লাগায় ।

কতটুকু বলেছ ?

একটা মেয়ে নিজের এক্স নিয়ে সচারাচর যতটুকু বলে ।

তোমার হবু বরের প্রতিক্রিয়া কি?

সে বুঝতে পেরেছে, সময়ের দাবীকে অস্বীকার করে কি করে ! নতুন কোন প্রশ্ন করে নাই ।

সহসাই দুই জনের কথা শেষ হয়ে যায় । তারা কফির কাপ সামনে নিয়ে মুখোমুখি বসে আছে । নিরবতা ভাঙ্গতেই নীলা বলে,

তোমার কথা বল ?

আমার আবার কি কথা ? আকাশের কোন কথা নাই ।

চাকুরী তো হচ্ছে না, কি করবে ?

জানি না । আকাশ সত্যিই জানে না সে কি করবে । আকাশ, নীলার অফিস থেকে বের হয়ে আসে । মে মাসের গরমে পুরোটা রাস্তা হেঁটে ঘামে জবজবা হয়ে বাসায় ফিরে । সিদ্ধান্ত নেয় বাসা পাল্টাবে; যত শীঘ্র সম্ভব ।

নীলার বিয়ের পর হতেই আকাশের একটা সমস্যার শুরু হয়েছে । সে রাতে ঘুমাতে পারে না । ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে ।

ঘুমালেই একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখে নর্দমার পানিতে ভেসে যাচ্ছে । ছোট্ট দুইটা হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছে । আকাশ বাচ্চাটাকে ধরতে ছুটে যাচ্ছে, ধরতে পারছে না । বাচ্চাটা নর্দমার পানিতে হারিয়ে যাচ্ছে । ভয়াবহ অবস্হা । জেগে যাবার পরও বাচ্চার কান্না কানে লেগে থাকে । আকাশ, দুঃস্বপ্ন হতে মুক্তি পাবার জন্য এক বন্ধুর শরণাপন্ন হয় । বন্ধু মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক, একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায় । তাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে হয় হয় ।

বন্ধুটি বস্তুবাদ বিশ্বাসী । পাপ পূণ্য, আবেগের কাছ দিয়েও যায় না ।

জিজ্ঞেস করে,

তোমার কি মনে হচ্ছে নীলা তোমার সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে ?

আকাশ চুপ করে থাকে । বন্ধুর প্রশ্নের কি উত্তর দিবে সহসা ঠিক করতে পারে না ।

বন্ধুটি বলে, ভাব; এই খানেই তোমার সমস্যার সমাধান লুকিয়ে আছে । তুমি নিজেও জান না, কে অন্যায় করছে । শুন, সম্পর্কের বিভিন্ন পর্যায় থাকে, কখন কখন কেউ ক্লান্ত হয়ে যায়, সম্পর্কটা ক্যারী করতে চায় না কিংবা ধরো, কেউ ক্যারী করতে পারে না । দোষ ধরে বসে থাকলে জীবন চলবে না, সবার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার আছে ।

তুমিও তোমার মতো বাঁচ ।

বন্ধুটি সব কিছু যুক্তি দিয়ে বিচার করে, দুঃস্বপ্ন হতে মুক্তি পাওয়ার জন্য কি করতে হবে ব্যাখা করে । বন্ধুর কথা মতো আকাশ শারীরিক পরিশ্রম শুরু করে । সকালে আর সন্ধ্যার পর দুই ঘন্টা শরীরের ঘাম ঝরায় । বন্ধু পরামর্শ কাজে লাগে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় যায়; দুঃস্বপ্নের মাত্রা কমে আসে ।

ঘটনা চক্রে তারা ভাই এর সাথে আকাশের পরিচয় হয় । আকাশ, তারা ভাই এর ভাল নাম জানে না । তারা ভাই এর সাথে কথা বলে প্রথম প্রথম সবাই বিভ্রান্ত হবে । তারা ভাই কথার শুরুতে কখনও তুমি, কখনও আপনি আবার কখনো তুই বলে সন্মোধন করে । বিভ্রান্ত না হয়ে উপায় কি ? আকাশের মনে হতো তারা ভাই নেশা টেশা করে; সারাক্ষন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে । কথা বলার সময় চোখ দু’টি জ্বল জ্বল করতে থাকে । বুয়েটের কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিল, এক সময় আকাশের মতো পত্রিকা অফিসে খন্ডকালীন কাজ করতো ।

এখন কিছুই করে না ।

তারা ভাই বলে, জীবনের সব চাহিদাই নিজেকে সাজানোর অংশ । চাইলে লাগে, না চাইলে লাগে না; বেশ চলে যায় । সত্যিটা হলো তুমি চাওয়াটাকে নিয়ন্ত্রন করতে পার কিনা ! আকাশের মনে হয় কথাটা খুবই সত্যি ! দুইটা শার্ট হলেও যেমন চলে আবার দশটা শার্ট হলেও চলে । দশটা শার্টের যে দরকার নাই, এটাকে বিশ্বাস করা, নিজের ভেতর নিয়ে আসাটাই মূল ব্যাপার । কে কি ভাবল, বলল, কি যায় আসে; নিজের মনের আনন্দই বড় ব্যাপার । তারা ভাই জিজ্ঞেস করে,

আকাশ, সাধু পুরুষদের জন্ম নেয়া কি বন্ধ হয়ে গেছে ? যুগে যুগে, দেশে দেশে, মানবতার কথা যারা বলতো, তাদের আসা কি বন্ধ হয়ে গেছে ? যারা জীবনের সত্য সন্ধানে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, সে রকম সাধু পুরুষরা কি আর জন্ম নেন না?

আকাশের জন্য নতুন সংকেত , সে তারা ভাইকে পাল্টা প্রশ্ন করে,

প্রশ্নটা আপনাকে করা হলে কি উত্তর দিতেন ?

আমার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নাই, নিজেই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে বের কর । তোমার জানার আগ্রহই উত্তরটাকে তোমার কাছে নিয়ে আসবে ।

আকাশ আবার পড়াশুনা শুরু করে । শুরু করে লালন দিয়ে, ধীরে ধীরে এগুতে থাকে, শ্রীরামকৃষ্ণ, এক সময় হাতে নেয় কোরআন্ । তারা ভাই এর সাথে আলোচনা চলে, অনেক সময় তাদের সময়ের হিসাব থাকে না । তারা ভাইও আকাশকে লক্ষ্য করে, আকাশ ডিবেট করতো, সে আলোচনায় যুক্তির পর যুক্তি নিয়ে আসে । আকাশ পড়াশুনায় মনোযোগী, নতুন কিছু জানার প্রবল আগ্রহ আছে । আকাশকে সংসারের মায়া টানে না। একটা দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করছে । তারা ভাই মনে মনে হাসে, জীবনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু করার জন্য উত্তম চরিত্র । তারা ভাই আকাশকে বলে, তোর জীবনের প্রথম আর দ্বিতীয় অধ্যায় তুই পার করে এসেছিস । ভোগের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে এবার তুই সত্য সন্ধানের তৃতীয় অধ্যায়ে পা রাখ, দেখ কিছু খুঁজে পাস কিনা ?

আকাশ জীবনের তৃতীয় অধ্যায় শুরু করে । সে দুঃস্বপ্নের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পায় । আকাশ নিজের সত্তার মুক্তির পথ খুঁজতে শুরু করে, লক্ষ্য বিচিত্র স্তরের এক রহস্যময় জগত । পথ চলার শুরুটা আঁধারে হলেও ক্রমশ দৃষ্টি সীমানায় আলোর সন্ধান পায়, তার পথ চলার গতি বাড়ে ।

আকাশের আরামবাগের ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার ঠিক সাড়ে চার বৎসর পরের এক সন্ধ্যা । ধানমন্ডি, এক সময়ের অভিজাত আবাসিক এলাকা । এই এলাকা এখন আর পুরোপুরি আবাসিক নাই । প্রাইভেট কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর ঝমকালো রেষ্টুরেন্টে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে । কিছু অভিজাত অফিসও আছে ।

সামনে গাড়ীর লম্বা সারি । মনে হচ্ছে গাড়ী আর এগুবে না । নীলা গাড়ী থেকে রাস্তায় নেমে আসে ।

নীলা এক সাধকের ঠিকানায় যাবে । খুব দূরে না, বাকী পথটুকু হেঁটেই যেতে পারবে । ড্রাইভারকে গাড়ী পার্ক করতে বলে নীলা হাঁটতে শুরু করে । তার কলিগ রোজী, এই সাধকের ঠিকানা দিয়েছে । রোজী বলেছে, বিরাট কামিল হুজুর, একবার নেক দৃষ্টিতে তাকালেই নীলার কাজ হয়ে যাবে ।

নীলার বিশ্বাস না করে উপায় নাই । নিজের ঘরটা বড্ড খা খা করে । তার দরকার একটা সন্তান । একটা সন্তানের জন্য, নিজের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য, নীলা সব কিছু করতে পারে । নীলার স্বাভাবিক ভাবে মা হবার কোন সম্ভাবনা নাই, ডাক্তার তাকে জবাব দিয়ে দিয়েছে । তার স্বামীর কোন সমস্যা নাই, তার বাবা ডাক শুনার আকাংখা বাড়ছে । প্রতিদিন ঘরে অশান্তি হয় । রোজীর পরামর্শে নীলা সাধকের সাথে দেখা করতে চলেছে ।

যদি কিছু হয় !

অলৌকিক কত কিছুই তো ঘটতে পারে । রোজীর কাছে হুজুরের ঠিকানা পেলেও, তার কথা মতো হুজুরের এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া সহজ হয় নাই । নীলা দীর্ঘ দুই মাস অপেক্ষার পর আজ ডাক পেয়েছে । লীনা, নিজ হাতের কাগজটা আবার দেখে । সে ঠিকানা মতোই উপস্হিত হয়েছে । গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার আগে নীলা নিজেকে দেখে, নীলা নিজের পড়নের পোষাক নিয়ে সন্তুষ্ট; তার পোষাক শালীনতার ভেতরেই আছে । হুজুরের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারটা কতক্ষনে শেষ হবে, নীলা বুঝতে পারছে না । রোজী বলেছে, সন্ধ্যার পর হতে ওখানে ভীড় বাড়তে থাকে । এশার নামাজের পর হতে মধ্যরাত পর্যন্ত হুজুরের সাথে সাক্ষাত পর্ব চলে । হুজুর একেবারে ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় যান ।

বাড়ির সামনে গাড়ীর ভীড়, ভেতরের মানুষের ভীড়, নীলা ঘাবড়ায় না, তার এপয়েন্টমেন্ট ঠিক করাই আছে; হুজুরের সাক্ষাত পেতে সমস্যা হবার কথা না । অপেক্ষমান এলাকাটাও দেখার মতো । পুরুষ এবং মহিলাদের আলাদা আলাদা অপেক্ষমান কামরা । ভেতরে এতো মানুষ, সামান্য শব্দটুকুও নাই । সবাই যেন মূক হয়ে বসে আছে; ইশারায় সব কাজ সাড়ছে । সবই ঘড়ির কাঁটা ধরে ঘটছে । নীলা একটু আগেই এসে পড়েছে । প্রথমবার বলে এপয়েন্টমেন্টে উল্লেখিত সময়ের উপর ভরসা রাখতে পারে নাই । এখন বুঝতে পারছে, এখানে সময়ের উপর বিশেষ জোড় দেয়া হয় । নীলা চারপাশ দেখে, অভিজাত শ্রেনীর প্রতিনিধি বেশী । সবাই ভেতরে যাবার প্রতীক্ষায় আছে ।

চল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর নীলার ভেতরে যাবার ডাক আসে । একজন সহকারী নীলার দৃষ্টি আকর্ষন করে শুধু ইশারায় হাতের ঘড়িটা দেখায়, নীলা বুঝতে পারে তার হুজুরের সাক্ষাত লাভের সময় হয়েছে । ধীর পদক্ষেপে নীলা হুজুরের খাস কামরায় প্রবেশ করে ।

নীলা সাধকের খাস কামরায় ঢুকে অবাক হয়ে যায় । এতো বড় কামরা সে জীবনে দেখে নাই, কামরাটা তার বেড রুমের তিন গুনেরও বড়, সেই তুলনায় আসবাবপত্র নাই বললেই চলে । এক পাশে একটা ডিভান, কামরার মাঝামাঝি হাতল ছাড়া দুইটি চেয়ার; ঠিক তার উপরেই ছাদ হতে বিশাল একটা ঝাড় বাতি ঝুলছে । নীলার খালি পা, নরম কার্পেটে গোড়ালি অবধি ডেবে গেছে । নীলা আগর বাতি কিংবা আতরের গন্ধ আশা করেছিল, সে কামরায় অন্যরকম একটা গন্ধ পাচ্ছে । কামরার ভেতরটা বেশ ঠান্ডা, তাপমাত্রা ষোল ডিগ্রী হতে পারে, বাইরের তীব্র গরমের কোন আলামত নাই । হঠাৎ ঠান্ডার একটা ঝাপটা নীলার প্রতিটি লোমকূপ নাড়িয়ে দিয়েছে । কামরার আলোর মধ্যেও এক ধরনের রহস্য আছে । মনে হচ্ছে পুরো কামরাটাই আধো অন্ধকার আবার যা দেখা দরকার সে ঠিকই তা দেখছে ।

নীলা দাঁড়িয়ে পড়ে ।

সে কোথায় এলো ? মনে হচ্ছে সে পুরো পৃথিবী হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ।

ডিভানের উপর একজন বসে আছেন । উনিই বোধ হয় সাধক, সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছেন । নীলার আরেক দফা অবাক হবার পালা । সাধকের মাথায় পাগডী, কপালের কিছু অংশ ঢেকে গেছে; তারপরও তাকে চিনতে নীলার কোন সমস্যা হচ্ছে না ।

নীলা সম্মহিতের মতো ডিভানের দিকে এগিয়ে যায় ।

আলোটা নীলাকে অনুসরন করছে । মনে হচ্ছে স্বয়ংক্রীয় ভাবে আলো নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, ক্রমশ আলোর তীব্রতা বাড়ছে; নীলা এখন সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ।

নীলা কাছে যেতেই সাধক ডিভান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন । নীলা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, সেই চোখ, চোখে গাঢ় করে সুরমা দেয়া । সাধকের পরিচিত চোখে অচেনা দৃষ্টি । সাধক সম্মোহনী দৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে; চোখের পলক পড়ছে না । নীলার মনে হচ্ছে, তীক্ষ্ন শীতল দৃষ্টিতে সাধক নীলার ভেতরটাও দেখে নিচ্ছে । নীলাও সাধককে দেখছে, তাকে এখন সদ্য কৈশোর পেরুনো যুবকের মতো লাগছে । নীলা বলে,

তুমি ?

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ । সাধকের গম্ভীর কন্ঠের সালামের শব্দে কামরাটা গম গম করে উঠে ।

নীলা সালামের জবাব দেয় না । তার ঘোর কাটে নাই, সে আবার জিজ্ঞেস করে,

তুমি ?

আগন্তুক নারীর এই প্রশ্নের উত্তর সাধকের কাছে নাই । তার নশ্বর দেহের ভেতর আগন্তুক নারী কার পরিচয় খুঁজছে?

সাধক তো কেবল শোভিত, সে কেউ না; তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । সাধক নিজেকে জানার চেষ্টা করছে । সে নিজের স্বত্তা খুঁজতে গিয়ে নিজের আদি পরিচয় বিস্মৃত হয়েছে । সাধক নিজের কাছেই যেখানে অচেনা, সেখানে আগন্তুকের প্রশ্নের কি জবাব দিবে?

নীলা খুব কাছ থেকে সাধককে দেখে, কত কাছের মানুষ অথচ এখন কত দূরে । নীলা কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,

আকাশ, অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম, তোমাকে এখানে দেখব আশা করি নাই । আমার সংসার যে আর টিকে না ! নীলার কন্ঠে সত্যিকার হতাশা ঝড়ে পড়ে ।

সাধক, আগন্তুক নারীর হতাশাটা কারনটা বুঝতে পারছে । সে অলৌকিক কিছুর প্রত্যাশা করেছিল, যা পায় নাই । চেনা মুখ প্রত্যাশার লাগামকে টেনে ধরেছে, কল্পনার চারপাশে সীমা রেখা এঁকে দিয়েছে ।

আগন্তুকের হতাশা সাধককে স্পর্শ করে না । সাধক বলে,

যুক্তির দুনিয়ায় অলৌকিক কিছু খুঁজা বৃথা । একটা মাত্র লাইন, পুরো ঘর আবারো গমগম করতে থাকে, নীলা চমকে উঠে; এই শব্দের সৃষ্টি পৃথিবীতে না, সে অবাক বিশ্ময়ে সাধকের দিকে তাকিয়ে থাকে ।

আমি জানি আপনি কেন এসেছেন । সৃষ্টির দাবী, আপনার চাওয়া আপনাকে তাড়িত করবে; এটাই স্বাভাবিক । আপনি এখানে আসবেন, নয়তো অন্য কোথাও যাবেন, শান্তি খুঁজবেন; সবাই শান্তি খুঁজে ।

আকাশ আমার একটা সন্তান চাই ।

সাধক আগন্তুকের চোখে চোখ রাখে, বলে,

আপনি সেই ক্ষমতা হারিয়েছেন । যে ক্ষমতা স্রষ্টা কেড়ে নিয়েছে তা ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা কোন সাধকের নাই, কোন মানুষের নাই ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :