পকেট কাটার নতুন কৌশল ‘ওয়েবিল’

প্রকাশ | ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪৫

কাজী রফিক

বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নিত্যনূতন যত ফন্দি আবিষ্কার হচ্ছে, তার মধ্যে একটি ওয়েবিল। সিটিং সার্ভিস নামে চলা বাসগুলো একটি নির্ধারিত দূরত্বের পরপর কতজন যাত্রী উঠেছে, সেটি গণনা করে ওয়েবিলে তাদের সংখ্যা লিখে দেন পরিবহন কোম্পানির লোকজন। আর একটি ওয়েবিল থেকে আরেকটি ওয়েবিল পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করা হয়।

এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় দিয়ে নিত্যদিন ঝগড়া হচ্ছে বাসে। কিন্তু পরিবহন মালিক ও চালকরা গায়ের জোড়ে বাধ্য করছে যাত্রীদের বাড়তি টাকা দিতে। 

ওয়েবিলে ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়েছে এমন কৌশল যেখানে যাত্রীর পকেটে চাপ পড়ে বেশি। ওয়েবিলগুলো এমন জায়গায় বসানো হয়েছে যেখানে যাত্রী কম নামেন। ফলে জনবহুল স্থানগুলোতে যেতে পরের ওয়েবিলের ভাড়া দিতে হয়। যেমন ফার্মগেট পার হয়ে বাংলামোটরের দিকে আসতে চাইলে যাত্রীদের কাছ থেকে গুলিস্তানের ভাড়া আদায় করতে ওয়েবিল বসানো হয়েছে সোনারগাঁও হোটেলের সামনে। যদিও সেখানে যাত্রী উঠানামার কোনো নির্ধারিত স্থান নেই।

আবার মহাখালী হয়ে আসা বাসগুলোর ওয়েবিল বসানো হয়েছে সাত রাস্তার আগে। অর্থাৎ যারা সাতরাস্তা বা মগবাজার যাবেন, তাদের ভাড়া দিতে হয় গুলিস্তান পর্যন্ত। একই অবস্থা প্রায় সবগুলো রুটে।

বাসভাড়া কত হবে, সেটি নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ। আর যে কমিটি করে এই ভাড়া নির্ধারণ হয়, সেখানে থাকেন পরিবহন মালিকরা। বরাবর অভিযোগ আছে, যাত্রীদের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে পরিবহন মালিকদের দিকেই ঝুঁকে বিআরটিএর সিদ্ধান্ত। তবে তারা যে ভাড়া নির্ধারণ করে, তার চেয়েও বেশি আদায় করা হচ্ছে বাসগুলোতে। নানা সময় ঘোষণা দিলেও বিআরটিএ বা সড়ক মন্ত্রণালয় কার্যকর কিছুই করতে পারে না। আর সড়ক নিরাপত্তা বা শৃঙ্খলা রক্ষায় নানা সময় অভিযান চালানো হলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার নজির একেবারেই কম। 

নগরীতে পরিবহন মালিকরা এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও কঠিন। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অভিযানের সময় ধর্মঘট বা বাস কমিয়ে দিয়ে পাল্টা চাপ তৈরি করেন তারা। ফলে তারা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (রোডস অ্যান্ড সেফটি) শেখ মাহবুব ই রব্বানী ঢাকা টাইমসে তাদের অসহায়ত্বের কথাই জানিয়েছেন। বলেন, ‘আসলে এ বিষয়ে আমাদের তেমন কিছু করার নেই। যখন মোবাইল কোর্ট চালাই, তখন অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন নেই। এই ধরনের অভিযোগ যাত্রীরা তেমন একটা করে না।’

তাহলে কি যাত্রীরা এভাবে ঠকতেই থাকবেন?- এমন প্রশ্নে বিআরটিএ কর্মকর্তা বলেন, ‘অবশ্যই করার আছে। যদি কেউ গাড়ির নাম উল্লেখ করে অভিযোগ করে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব।’

সবশেষ ২০১৫ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাসভাড়া বাড়ানো হয়। কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ে ১০ পয়সা। প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়। আর মিনিবাসের ক্ষেত্রেও ১০ পয়সা বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১ টাকা ৬০ পয়সা। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ভাড়া রাখা হয় বাসের ক্ষেত্রে ৫-৭ টাকা ও মিনিবাসের ক্ষেত্রে ৫ টাকা।

তবে ২০১৭ সালে অঘোষিতভাবে ভাড়া বাড়ায় গণপরিবহন মালিকরা। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয় দুই টাকারও বেশি। কোথাও কোথাও স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৫-১০ টাকা পর্যন্ত। আর এরপরও সির্টিং সার্ভিস বা অন্য নামে পকেট কাটা চলছে। ২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালে এই ধারাবাহিকতায় চালু হয় ‘ওয়েবিল’। যেটি ‘লাভজনক’ হওয়ায় প্রায় প্রতিটি রুটেই চলছে এই অনিয়ম।

বাড়তি ভাড়া আদায়ের যত কৌশল

বাসগুলো প্রতিটি মোড়েই থামে, যাত্রী উঠানামা করে যেখানে সেখানে, কিন্তু ওয়েবিলের নামে ভাড়া আদায় করা হয় দূরের যাত্রার। যেসব স্থানে যাত্রীদের চাপ বেশি থাকে তার ১০০ থেকে ২০০ মিটার আগে ওয়েবিল স্বাক্ষরের স্থান বসানো হয়েছে। এতে করে স্বল্প দূরত্বের জন্য বাড়তি ১০ টাকা গুনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ যাত্রীরা।

যেমন মিরপুর, মোহাম্মদপুর বা মহাখালী হয়ে আসা বাসগুলোর বেশির ভাগ যাত্রীই ফার্মগেটে নামলেও এই মোড়ে ওয়েবিল নেই। শাহবাগ বা কারওয়ানবাজার পর্যন্ত ভাড়া আদায় করতে ওয়েবিল বসানো হয়েছে আরও সামনে।

রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত ওয়েবিলের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ টাকা। এর মধ্যে যেকোনো স্থানে উঠানামার জন্য ভাড়া ১০ টাকা। আর কেউ বাংলামোটর বা শাহবাগ গেলে ভাড়া ২৫ টাকা। অথচ ২৫ টাকা ভাড়া ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত।

বাংলামোটর বা শাহবাগে যাত্রী নামিয়ে বাসগুলো সেখান থেকেও যাত্রী তোলে। ১০ টাকা করে ভাড়া নেয়। বলাই বাহুল্য যাত্রীর অভাব পড়ে না।

রামপুরা থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচলকারী ‘স্বাধীন’, ‘রমজান’, ‘রাজধানী’ পরিবহনে স্টাফ কোয়ার্টার থেকে রামপুরা পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকা। আর ভেঙে ভেঙে যেখানেই যে নামুক, ওয়েবিলের কথা বলে ১০ টাকার নিচে ভাড়া নিতে চায় না। রামপুরা থেকে ‘স্বপ্ন’ পর্যন্ত এক কিলোমিটার দূরত্বেও একই পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়। এ নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে নিয়মিত ঝগড়া হয়।

মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলাচল করে স্বাধীন পরিবহন। মোহাম্মদপুর থেকে ডেমরা পর্যন্ত মোট পাঁচটি স্থানে ওয়েবিল স্বাক্ষর হয়। প্রতি ওয়েবিল ১০ টাকা বলা হলেও মোহাম্মদপুর থেকে বাংলামোটরগামী যাত্রীদের থেকে ভাড়া আদায় করা হয় ১৫ টাকা। অথচ এর মধ্যে ওয়েবিল স্বাক্ষরের স্থান একটি।

মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিল রুটে চলাচল গাড়ির ক্ষেত্রে ওয়েবিল দুটি। প্রতি ওয়েবিল ১০ টাকা হারে মোট ভাড়া ২০ টাকা। মোহাম্মদপুর থেকে ছেড়ে আসা মিডলাইন, সিটিবাস ও রজনীগন্ধা পরিবহনের একটি ওয়েবিল সই হয় ঝিগাতলায় অপরটি শাহবাগ শিশু পার্কের সামনে। এক্ষেত্রে মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ঢাকা ১০ টাকা হওয়ার কথা থাকলেও এলিফেন্ট রোডের বাটা সিগন্যাল পার হলেই যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। আবার ওয়েবিলের ফাঁদে পরে মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি থেকে মৎস্য ভবন যাওয়া যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২০ টাকা।

ত্যক্তবিরক্ত যাত্রীরা

মোহাম্মদপুর-মতিঝিল রুটের নিয়মিত যাত্রী সাগর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দিন দিন একেকটা নতুন নিয়ম আনে। নিয়ম তো না, আসনে সব টাকা কামানোর রাস্তা। নিয়ম বানাইয়া ভাড়া বাড়ানো হয়। আমরাও কিছু বলতে পারি না। কে সকালবেলা ওদের সাথে চিল্লাচিল্লি করে।’

সর্বশেষ বাস ও মিনিবাসের ভাড়া নীতিমালা অনুসারে ঢাকা মহানগরীতে বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা এবং মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা। কিন্তু ১০ টাকার নিচে ভাড়া আদায় করতে দেখা যায় না কোনো পরিবহনকেই।

বাড়তি ভাড়ার নৈরাজ্যে বিরক্ত রাজধানীবাসী। শাহ নেওয়াজ নামের এক যাত্রী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ওয়েবিল করার পর সার্ভিস আরও খারাপ হয়েছে। লোকাল গাড়ি সব। বাসের ভেতরে এরা এমনভাবে যাত্রী নেয়, আপনি নড়তে পারবেন না। কিন্তু ভাড়া সিটিং। আবার ওয়েবিল। এই ওয়েবিলটা আসলে কি? আমার তো মনে হয় ভাড়া বেশি নেওয়ার কৌশল এটা।’

মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদ থেকে আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী তেঁতুলিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ (মাসুদ) মানতেই নারাজ যে তারা অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বিআরটিএ আমাদের ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা একটা স্লোপ করেছি। আমরা সে হিসেবে ভাড়া নেই।’

তার দাবি অনুযায়ী বাসটিতে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা। কিন্তু সরজমিনে দেখা গেছে তেঁতুলিয়া পরিবহনে ১০ টাকার নিচে কোনো ভাড়া নেওয়া হয় না। একই সাথে রয়েছে ওয়েবিল বিতর্ক। আব্দুল্লাহপুর থেকে শ্যামলী পর্যন্ত ৩০ টাকা ভাড়া হলেও শ্যামলী থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত ভাড়া ১৫ টাকা।

পরিবহন মালিকের দাবি, শিয়া মসজিদ থেকে শ্যামলী যাওয়ার জন্য তাদের গাড়িতে যাত্রী ওঠে না। এখানে লেগুনা আছে, তারা লেগুনায় যায়।

এ রুটের যাত্রী আনোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি এদের গাড়িতে নিয়মিত। প্রতিদিন উত্তরা যাই-আসি। আমার বাসা শিয়া মসজিদ। কিন্তু আমি শ্যামলী নেমে যাই। শুধু আমি না, অনেক যাত্রীই নেমে যায়। উত্তরা থেকে শ্যামলীর ভাড়া ৩০ টাকা এটা মানা যায়। শ্যামলী থেকে শিয়ামসজিদ ভাড়া কীভাবে ১৫ টাকা হয়? রিকশায়ই তো ২০ টাকায় যাওয়া যায়। এজন্য নেমে লেগুনায় পাঁচ টাকা দিয়ে চলে আসি।’

বাড়তি ভাড়া আদায়ের কারণ হিসেবে পরিবহন মালিকদের দায়িত্বহীনতাকেও দায়ী করেছেন এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু পরিবহনের মালিক বাবুল শেখ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘দূরত্ব হিসেবে যে ভাড়া হওয়ার কথা আমি আমার গাড়িতে তার চাইতে পাঁচ টাকা, ১০ টাকা কম নেওয়ার চেষ্টা করি। আমিসহ আমার কোম্পানির লোকজন রাস্তায় থাকে। এটা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু সব পরিবহনের মালিকরা এই দায়িত্বটা পালন করে না। সবাই সবার দায়িত্ব পালন করলে ঝামেলাগুলো কমে আসত।’

যাত্রীকল্যাণ সমিতি যা বলছে

যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাসে পকেট কাটা নিয়ে ক্ষুব্ধ। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘গাড়ির মালিকরা কোনো আইনের তোয়াক্কা করে না। দেখবেন মিনিবাসের ২৬ আসন, কিন্তু কোনোটাতে ৪০টার নিচে নাই। বড় বাসে ৪১ আসন থাকার কথা, কিন্তু আছে ৬০ ওপরে। তাহলে এখানে এটাই প্রতীয়মান হয় আমাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতারণা করা হচ্ছে। সিটিং সার্ভিসের নামে গাড়িতে ওয়েবিল রেখে যাত্রীদের মাথা গুনে টাকা আদায়, কোনো নীতিমালায় স্বীকৃতি দেয় না এটা।’

মোজাম্মেল বলেন, ‘এখানে আমরা প্রতারণার স্বীকার, সিটি সার্ভিস নামে স্বল্প দূরত্বে যাব। কিন্তু সেখানে ওয়েবিলের নামে লাস্ট গন্তব্য পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, এটা আইনসিদ্ধ নয়। আমরা বরাবরের মতো সরকারের কাছে দাবি করছি এই প্রতারণা থেকে আমাদের মুক্ত করুক।’