উপমার ফারজানা

আজহারুল আজাদ জুয়েল
 | প্রকাশিত : ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫৭

ঠাকুরগাঁও শহরের মুন্সীপাড়ার মেয়ে ফারজানা তখন ডিগ্রির ছাত্রী। তার এলাকার পাশের খালপাড়া, আশ্রমপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় সুবিধাবঞ্চিত অনেক পরিবারের নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিরক্ষরতা আর সচেতনতার অভাব প্রকট। সুবিধাবঞ্চিত এই পরিবারগুলো ছোটখাটো কোনো সমস্যায় পড়লেও সমাধানের পথ খুঁজে পেত না তারা। এসব দেখে ফারজানার মন ভারী হয়ে উঠত।

তাদের কল্যাণে কিছু করার ভাবনা থেকে তিনি এলাকার কয়েকজন মানুষের সঙ্গে আলাপ করেন, যাদের কেউ বন্ধু, কেউ আত্মীয়, কেউ প্রতিবেশী। বিশেষ করে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সংগঠিত করে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য পথ খুঁজে বের করতে চান ফারজানা।

তারই ফল সুবিধাবঞ্চিত নারীসমাজের উন্নয়ন ও কল্যাণের ছোট্ট সংগঠন উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থা। সংগঠন এখনো ছোটই আছে কিন্তু নারী ও শিশুকল্যাণে অনবদ্য অবদান রেখে ফারজানা আখতার পাখি নিজেকে ছড়িয়েছেন উচ্চতর মাত্রায়।

সময়টা ২০০১ সালের প্রথমার্ধ। ফারজানার আহ্বানে বৈঠকে বসেন তার বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশীরা। সেখানেই জন্ম নেয় উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থা। এলাকার শামিমা সুলতানাকে সভাপতি ও ফারজানাকে নির্বাহী সম্পাদক করে গঠিত হয় সংস্থার প্রথম কমিটি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে সংগঠনটির অসাম্প্রদায়িক চরিত্র রূপায়নের চেষ্টা ছিল। তাই ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই সংগঠনের নেতৃত্বে ও সেবা-সুবিধা প্রাপ্তিতে যুক্ত ছিল সবাই।

ফারজানা জানেন এলাকায় নিরক্ষতার সমস্যা অতিমাত্রায়। তাই প্রতিষ্ঠার শুরুতে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। সদস্যরা নিজেরা ১০০ টাকা করে চাঁদা দিয়ে সর্বমোট ২৫০০ টাকায় ৫টি বয়স্ক স্কুল পথচলা শুরু করে। এখানে প্রধানত নিরক্ষর মহিলাদের সাক্ষরতা জ্ঞাণসহ সাধারণ শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষকরা কাজ করেন স্বেচ্ছাশ্রমে এবং তারা সফল হন।

ফারজানার এই উদ্যোগ সফলভাবে চললে এলাকার মানুষ আরো অর্থ সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে। এরপর ২০০৮ সালে এগিয়ে আসে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশন নামের একটি জাতীয় সংস্থা। তারা চারটি স্কুলের জন্য অর্থায়ন করে। ওই কর্মসূচি সফল হলে এগিয়ে আসে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর। এই দপ্তর থেকে সাধারণ স্কুলের ঝরে পড়া শিশুদের জন্য উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে ১০০টি আনন্দ স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। চালু হয় ঝরে পড়া শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমে পাঠদান কর্মসূচি। এই কার্যক্রমও সফলভাবে শেষ হয়।

এভাবেই উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে ঠাকুরগাঁওয়ের দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘু নারী, শিশুদের কল্যাণে কাজ করে যান ফারজানা আখতার পাখি। ভালো কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। একটি ছোট সংস্থার মাধ্যমে ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা প্রশাসন থেকে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার, যুব নারীদের সফলভাবে সংগঠিত করায় জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ যুব সংগঠক পুরস্কার এবং নারীর ক্ষমতায়নে উদ্যোগ গ্রহণ ও অবদান রাখায় এনজিও ফাউন্ডেশন থেকে পান জাতীয় পর্যায়ে স্মারক সম্মাননা।

ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জন হেরিসন সম্মাননা, ফিদেল কাস্ত্রো সম্মাননাসহ আরো অনেক পুরস্কার পেয়েছেন ফারজানা। স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো তার সফল কাজের চিত্র তুলে ধরে বিভিন্ন সময়ে সংবাদ প্রকাশ করে।

উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার শুরুতে বয়স্ক শিক্ষার পাশাপাশি সঞ্চয় ও সমিতি গঠনের কার্যক্রম ছিল। বর্তমানে চলছে নারীর ক্ষমতায়ন, নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য উন্নয়ন কার্যক্রম। সংস্থার সবচেয়ে বড় কার্যক্রম হলো গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। ডিনেট নামের একটি সংস্থার অর্থায়নে এই কার্যক্রম ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলায় বেশ সাড়া ফেলেছে।

ফারজানা আখতার জানান, ডিনেটের অর্থায়নে পরিচালিত এই কর্মসূচির নাম ‘আপনজন।’ মোবাইল ফোনে মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয় এই কর্মসূচির মাধ্যমে। আপনজন কর্মসূচিতে একজন গর্ভবতী কিংবা প্রসূতি মায়ের সারা বছর সেবা নিতে বছরে খরচ হয় মাত্র ২০০ টাকা।

আপনজন কর্মসূচির উপকারভোগী ঠাকুরগাঁও বাসস্ট্যান্ড এলাকার শাম্মি আখতার, মুন্সীপাড়ার রোখসানা বেগম, হরিপুরের সাবিনা আখতার, রানীশংকৈলের তুলসী রানী। তারা মাত্র ২০০ টাকায় এই কর্মসূচিতে সদস্য হয়ে সেবা গ্রহণ করছেন সারা বছর। তারা জানান, আপনজন কর্মসূচির মাধ্যমে মোবাইল ফোনে ঢাকার ডাক্তারের সঙ্গে তারা প্রয়োজনমতো কথা বলেন। যতবার প্রয়োজন হয় ততবার ডাক্তারকে মোবাইল ফোনে তারা সুবিধা-অসুবিধার কথা জানান। এর জন্য আলাদা ফি দিতে হয় না। ডাক্তারের মোবাইল সাজেশনে তারা ভালো আছেন। ‘ফারজানা আপা’ তার সংস্থার মাধ্যমে এই সুবিধা তাদের এনে দিয়েছেন, এ জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ তারা।

নারীর ক্ষমতায়ন উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার অন্যতম লক্ষ্য বলে জানান ফারজানা আখতার। তার মতে, আর্থিক সক্ষমতার ভেতর দিয়ে নারীরা ক্ষমতায়িত হবে। কিন্তু অর্থ তো এমনি এমনি আসবে না। দরিদ্র নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তাকে কোনো কাজে দক্ষ হতে হবে, যেন ওই কাজের মাধ্যমে তিনি আয় করতে সমর্থ হন। যখন আয় হবে তখন পরিবার-সমাজ তার কথার মূল্য দেবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার পরামর্শ, অভিমত নেবে।

দরিদ্র নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ফারজানা আখতার সেলাই প্রশিক্ষণ, শপিং ব্যাগ তৈরি, আচার তৈরি, আধুনিক সবজি চাষ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। পাশাপাশি নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, প্রতিবন্ধিতা, মাদক ও যৌতুক প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির কার্যক্রম চালাচ্ছেন। উপমার পক্ষ থেকে নারীদের চাহিদাভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেন। এই সব প্রশিক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর সহায়তা নেন তিনি।

সম্প্রতি এনজিও ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ১৬ জন দরিদ্র নারীকে ১৬টি সেলাই মেশিন অনুদান দিয়েছেন ফারজানা। তাদের ছয়জন সনাতন ধর্মের। এখন ওই ১৬ নারীকে বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে যাতে তারা কাপড় সেলাইয়ের মাধ্যমে আয়-রোজগার করতে পারেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই পর্যন্ত পারিবারিক কলহ মেটাতে প্রায় অর্ধশত সমস্যা সালিশে সমাধান করেছে উপমা। ৩০টির মতো যৌতুকবিহীন বিয়ে দিয়েছে। উপমা পল্লী উন্নয়ন সংস্থার বর্তমান সভাপতি পারুল বেগম জানান, ‘উপমার যা কিছু অর্জন তা এসেছে ফারজানার মাধ্যমে। তিনি আমাদের অনুকরণীয়। আমরা তার নেতৃত্বে উপমাকে আরো এগিয়ে নিতে চাই।’

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

ফিচার এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :