বিশ্বের অতিদরিদ্র আর ধনী দেশ

কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ?

প্রকাশ | ২২ জানুয়ারি ২০১৯, ১৯:৩৮

শেখ আদনান ফাহাদ

একটি দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করে সেদেশ কতটা ধনী কিংবা কতটা গরিব, সেটি বের করা যায়। মাথাপিছু হিসাব সমাজের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র হয়তো উপস্থাপন করে না, কিন্তু একটি দেশ কতখানি বিত্তের অধিকারী সেটি ভালোই নির্দেশ করতে পারে।

‘ফোকাস ইকোনমিকস’ নামের গবেষণা প্রতিষ্ঠান খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের সহায়তায় ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১২৭টি দেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আলোকপাত করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক, বিমাসহ ১০০০ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা নিরূপণ করা হয়েছে। এতে বের হয়ে এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে গরিব আর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর নাম। একই বিশ্ব, অথচ এত পার্থক্য আর বৈষম্য দেখে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে যেকোনো সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে।

সাব-সাহারান আফ্রিকা অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর অবস্থান। স্বৈরাচারী সরকার, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্বল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, অপ্রতুল অবকাঠামো, দুর্নীতি, বিদেশি বিনিয়োগের অভাব ইত্যাদি নানা অসুবিধায় জর্জরিত এই গরিব দেশগুলো। সবচেয়ে গরিব দেশগুলোর মধ্যে পাঁচটি দেশ বাইরের পৃথিবী থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। চারপাশে পাহাড়,  পর্বত, জঙ্গল। কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। কয়েকটি দেশ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। অথচ এই গরিব দেশগুলোও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ; তাদেরও তরুণ জনগণ রয়েছে। কিন্তু সম্পদ থেকেও এগুলো কাজে লাগাতে পারছে না দেশগুলো।

আসুন জেনে নেয়া যাক, বিশ্বের সবচেয়ে গরিব আর সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলো সম্পর্কে। গরিব রাষ্ট্রগুলোর নাম দিয়েই শুরু করা যাক।

‘ফোকাস ইকোনমিকস’-এর গরিব রাষ্ট্রের তালিকায় প্রথম নামটি আফ্রিকার ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো’। ২০১৭ সালে এই দেশের মাথাপিছু জিডিপি হিসাব করা হয়েছে ৪৩৯ মার্কিন ডলার। ২০১৯ ও ২০২৩ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৪৭৫ ও ৫৫১ ডলার।

তালিকার দ্বিতীয় নামটি আফ্রিকা মহাদেশের রাষ্ট্র মোজাম্বিকের। ২০১৭ সালে মোজাম্বিকের জিডিপি মাথাপিছু ৪২৯ ডলার। ২০১৯ ও ২০২৩ সালে দেশটির মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে যথাক্রমে ৫০২ ও ৬৪৮ ডলার। আফ্রিকার আরেকটি দরিদ্র রাষ্ট্র উগান্ডা স্থান পেয়েছে তালিকার তিন নম্বরে। ২০১৭ সালে উগান্ডার মাথাপিছু জিডিপি ৭২৬ মার্কিন ডলার; ২০১৯ ও ২০২৩ সালে হবে যথাক্রমে ৭৫৯ ও ৯৫৯ মার্কিন ডলার। তালিকার চতুর্থ স্থানে আছে এশিয়ার রাষ্ট্র তাজিকিস্তান। ২০১৭ সালে এর জিডিপি পার ক্যাপিটা ছিল ৭৭৭ মার্কিন ডলার; ২০১৯ ও ২০২৩ সালে তা দাঁড়াবে যথাক্রমে ৮৬১ ও ১১৫৯ মার্কিন ডলারে। তালিকার ৫ নম্বরে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেন। সৌদি জোটের হামলায় জর্জরিত দেশটির মাথাপিছু ২০১৬ সালে ছিল ৭৬২ মার্কিন ডলার; ২০১৯ ও ২০২৩ সালে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৯১৩ ও ১০৭৯ ডলার।

বাংলাদেশ গত ১০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। উন্নয়নের ধারা সমুন্নত থাকায় বাংলদেশ পৃথিবীর অতিদরিদ্র দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের কাতারে নিয়ে গেছে। ফোকাস ইকোনমিকস গ্রুপের তালিকায় জিডিপি পার ক্যাপিটার হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকার ১৫ নম্বরে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১৫২১.৩৬৬ মার্কিন ডলার; ২০১৯ ও ২০২৩ সালে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৭৭৪.৪৪ ও ২৫৪৭.১০৯ ডলারে। 

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যে শর্ত দরকার, তা পূরণ করায় আবেদন করার যোগ্য হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো। আগামী ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটবে।

জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বাংলাদশের প্রোফাইলে এখন বলা আছে, উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার যোগ্যতা গত মার্চেই অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় ছিল বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি সূচক (ইভিআই) এই তিন শর্ত পূরণ করতে হয়, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পূরণ হয়েছে।

মাথাপিছু জাতীয় আয় এক হাজার ২৫ ডলারের নিচে থাকলে সে দেশ এলডিসিভুক্ত হয়, এই আয় ১২৩০ ডলার অতিক্রম করলে ধাপ উন্নয়নের যোগ্যতা অর্জন হয়। বাংলাদেশের এখন এক হাজার ২৭৪ ডলার।

মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ৭২। এ ক্ষেত্রে ৬২ পর্যন্ত দেশগুলো এলডিসিভুক্ত, ৬৪ ছাড়ালে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়।

অর্থনৈতিক ঝুঁকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পয়েন্ট এখন ২৫ দশমিক ২। এই পয়েন্ট ৩৬-এর বেশি হলে এলডিসিভুক্ত হয়, ৩২-এ আনার পর উন্নয়নশীল দেশে যোগ্যতা অর্জন হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা আশাবাদী, এভাবে চললে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে কোনো সমস্যা হবে না।

উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠলে নানা দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত হলেও এখন বাণিজ্যিক নানা সুবিধা হারাতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়ন হলে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। বাংলাদেশ ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। মাথাপিছু আয়ের বিবেচনায় এ শ্রেণীকরণ করে বিশ্বব্যাংক। জাতিসংঘ দেশগুলোকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি), উন্নয়নশীল এবং উন্নত- এ তিন পর্যায়ে বিবেচনা করে।

সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে ভারতকে ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়েও ভারতকে পেছনে ফেলবে।

২০১৬ সালসহ আগের তিন বছরে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় ডলারের হিসাবে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু আয় বাড়ে ১৪ শতাংশ। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ মাথাপিছু আয়ে ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৩৫৫ ডলার। ভারতের একজন নাগরিক বর্তমানে একজন বাংলাদেশির চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি আয় করেন।  অথচ ২০১১ সালে বাংলাদেশিদের চেয়ে ৮৭ শতাংশ বেশি আয় ছিল ভারতীয়দের।

২০১৬ সালসহ আগের তিন বছরে চলতি মূল্যে ডলারের হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষেত্রে সমন্বিত বার্ষিক  প্রবৃদ্ধি (সিএজিআর) ১২ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার প্রায় অর্ধেক, ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। একই সময়ে পাকিস্তানের সিএজিআর ভারতের চেয়ে বেশি হলেও তা বাংলাদেশের চেয়ে কম ছিল। পাকিস্তানের সিএজিআর ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আর চীনের অর্থনৈতিক প্রসারের বার্ষিক হার ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

১৯৭০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরে ভারত ছিল অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ দেশ। চলতি মূল্যে ডলারের হিসাবে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আর পাকিস্তানে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।

গড় আয়ুতেও ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৫ বছর। ভারত ও পাকিস্তানে এই হিসাব যথাক্রমে ৬৮ দশমিক ৬ ও ৬৬ দশমিক ৫ বছর। শিশুমৃত্যুর হারও এই দুই দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কম।

বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে চীনের রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়ার বড় একটি ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেইজিংয়ের নীতিনির্ধারকেরা এখন জাতীয় চাহিদা ও বিনিয়োগেই বেশি মনোযোগী। ২০১৬ সালে চীনের রপ্তানি কমে দাঁড়ায় দুই লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। অথচ তার তিন বছর আগে তাদের রপ্তানি ছিল দুই লাখ ৩৫ হাজার কোটি ডলার। চীনের রপ্তানি কমায় বৈশ্বিক বাজারে অন্যদের ভোগ্যপণ্য রপ্তানির সুযোগ বেড়ে যায়। ভারত এই সুযোগ নিতে না পারলেও বাংলাদেশ নিতে পেরেছে। ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারতের পুঁজি, বিনিয়োগ ও রপ্তানির পরিমাণ কমেছে এই সময়ে। এই তিন বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ হারে।

মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে সবচেয়ে ধনী দেশের তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করে নিয়েছে লুক্সেমবার্গ।  ইউরোপের ছোট এই দেশটির ২০১৭ সালের জিডিপি পার ক্যাপিটা ছিল ১০৬৭১৯.১ মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে লুক্সেমবার্গের জিডিপি পার ক্যাপিটার দাঁড়াবে ১১৭৫৩৪.৮ মার্কিন ডলারে। জিডিপি পার ক্যাপিটার হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রের তালিকায় নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ইউএসএ ও কাতার আছে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক