সাত ব্যাংকে আমানতের বেশি ঋণ

প্রকাশ | ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪১

রহমান আজিজ

নির্ধারিত সীমার বাইরে ঋণ বিতরণ করেছে সরকারি-বেসরকারি ১৭টি ব্যাংক। এর মধ্যে যত আমানত সংগ্রহ করেছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে তিনটি ব্যাংক। আর চারটি ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং বিভাগ একই ঘটনা ঘটিয়েছে। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

আমানতের অতিরিক্ত ঋণ কীভাবে দেওয়া হয়েছে, সেই ব্যাখ্যায় একেক ব্যাংক বলেছে একেক কথা। কেউ আন্তব্যাংক লেনদেন বা কলমানি মার্কেট থেকে টাকা ধার করেছে। এখানে সাধারণ আমানতের চেয়ে বেশি খরচ পড়ে। আবার কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘পুনঃ অর্থায়ন তহবিল’ থেকে টাকা নিয়েছে। কোনো কোনো ব্যাংক আবার ঋণ অনুমোদন করানোর পর অল্প করে টাকা দিচ্ছে। তাদের আশা, আগের ঋণের সুদ এবং কিস্তি এলে ঋণের কিস্তিুও ছাড় করা হবে।

কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমানতকারীরা বড় অঙ্কের টাকা তুলতে গেলেই তৈরি হতে পারে ঝামেলা। কারণ, তখনো টাকা দিতে হবে আর বড় অঙ্কের হলে ধার করতে হবে অন্য জায়গা থেকে। এটাও ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করবে।

ব্যাকিং ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলছেন, ব্যাংকিং খাতে অব্যবস্থাপনার একটি নজির এই ঘটনা। নইলে আমানতের বেশি ঋণ হওয়ার কোনো কারণ নেই।

ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে পারবে, তা আইন দ্বারা নির্ধারিত। সাধারণ ব্যাংকগুলো তার আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ হিসেবে বিতরণ করতে পারে। আর ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো বিতরণ করতে পারে ৯০ শতাংশ। এই ঋণ আমানত হার এডিআর হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এখনো ১৭টি ব্যাংক মোট আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করছে। এর মধ্যে তিন সরকারি ব্যাংক অগ্রণীর ইসলামি শাখা, বেসিক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের ইসলামি শাখা, ফারমার্স, যমুনার ইসলামি শাখা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামি শাখা তার মোট আমানতের চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এডিআর সীমা লঙ্ঘন আমানতকারীর জন্য ক্ষতিকর। একই সঙ্গে ব্যাংকের জন্যও ক্ষতিকর। ব্যাংকগুলোকে এডিআর সীমা বেঁধে দেওয়া হয় ব্যাংকের এবং গ্রাহকের নিরাপত্তার স্বার্থে। এটি লঙ্ঘিত হলে ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়তে পারে। চিহ্নিত ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, এডিআর সীমা লঙ্ঘন মোটেও ভালো বিষয় নয়। এটি নিয়মের মধ্যে আনতে ব্যাংকগুলোকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর পরও যদি তারা এটি বাস্তবায়ন না করে, তবে অভিযুক্ত ব্যাংকগুলো পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই হিসাব গত সেপ্টেম্বরের প্রান্তিক পর্যন্ত। তবে ডিসেম্বরের বছর শেষে হিসাব এখনো আসেনি। ফলে এই সময়ের মধ্যে এডিআর সমন্বয় হয়েছে কি না, সেটি যাচাইয়ের সুযোগ নেই।

এডিআরের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা রাষ্ট্রীয় অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামি শাখা। এদের মোট আমানত যেখানে ৯৪ কোটি ৭৩ লাখ, সেখানে তারা ঋণ দিয়েছে ১৩১ কোটি ১০ লাখ টাকা। শতকরা হিসাবে আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি ১৩৮.৩৯ শতাংশ।

আমানতের ১২৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে বেসরকারি প্রিমিয়ারের ইসলামি শাখা। এদের মোট আমানত ৫১২ কোটি। কিন্তু ঋণ ৮১৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এরা আন্তব্যাংক লেনদেন থেকে ধার করেছে ১৫০ কোটি ১৮ লাখ টাকা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী রিয়াজুল করিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অতিরিক্ত টাকা আমরা আন্তব্যাংক লেনদেন থেকে ধার নিয়েছি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিফাইন্যান্স পেয়েছি। এতে কোনো সমস্যা নেই।’

অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৫০ কোটি ১৮ লাখ টাকা আন্তব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ধার নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘পুনঃ অর্থায়ন তহবিল’ থেকে কোনো ঋণ নেয়নি।

এবি ব্যাংকের ইসলামি শাখায় আমানত ৪৬১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু তারা ঋণ দিয়েছে ৫৩৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। ব্যাংকটি আমানতের ১১৬.৪৩ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছে।

ফারমার্স ব্যাংকের মোট আমানত চার হাজার ১০১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। কিন্তু তাদের ঋণ পাঁচ হাজার ১৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আমানতের তুলনায় ঋণ ১১২.২২ শতাংশ। এই ব্যাংকটি আন্তব্যাংক লেনদেন থেকে ধার করেছে ৫১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

বেসিক ব্যাংকের আমানত যেখানে ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, সেখানে তাদের ঋণ ১৫ হাজার ১০৬ কোটি ৪১ লাখ টাকা। অর্থাৎ এই ব্যাংক আমানতের ১১১.৪৬ শতাংশ ঋণ বিতরণ করে বসে আছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সরকার থেকে বেসিক ব্যাংক মূলধন পুনর্গঠনের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পেয়েছি। সেটি দিয়ে বেশ কিছু উচ্চ সুদে নেওয়া আমানত পরিশোধ করা হয়েছে। এ জন্য আমানত কম দেখাচ্ছে। ঋণ বিতরণে আমাদের তেমন কোনো সমস্যা নেই।’

যমুনা ব্যাংকের ইসলামি শাখায় আমানত ৩৭৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। কিন্তু তারা ঋণ দিয়েছে ৪১৯ কোটি ৯১ লাখ টাকা। অর্থাৎ আমানতের ১০৮ শতাংশ দেওয়া হয়েছে ঋণ। আন্তব্যাংক লেনদেন থেকে তারা ঋণ নিয়েছে ছয় কোটি ১৬ লাখ টাকা।

রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের আমানত চার হাজার ৯৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু তাদের ঋণ পাঁচ হাজার ৪৩৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ তাদের আমানতের ১০৬.২৮ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে ঋণ।

আরও ১০ ব্যাংকের অতিরিক্ত ঋণ

গত বছরের জানুয়ারিতে আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় এডিআর কমিয়ে নতুন সীমা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডিসেম্বর পর্যন্ত সাধারণ ব্যাংকে এডিআর ছিল ৮৫ আর ইসলামী ব্যাংকে ৯০ শতাংশ। তবে বেশ কিছু ব্যাংক তার সীমার বাইরে ঋণ দিয়ে বসে আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর সার্বিক এডিআর ৭৬ দশমিক ২৯ শতাংশ হলেও এর সীমা লঙ্ঘন করেছে ১৭ ব্যাংক।

বেসরকারি মালিকানাধীন এবি ব্যাংক এডিআর সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ করেছে। এবি ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করেছে ২৩ হাজার ২২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং এ সময়ে বিতরণ করেছে ২২ হাজার ৪১০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯১.৩৬ শতাংশ।

এক্সিম ব্যাংকের আমানত ২৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা হলেও ঋণ বিতরণ করেছে ২৭ হাজার ৮৬২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ৯৩.৬৮ শতাংশ।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এডিআর ৯১.৬৮ শতাংশ। এদের আমানত ২৯ হাজার ৯১৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর ঋণ বিতরণ হয়েছে ২৯ হাজার ৫৪৮ কোটি টাকা।

ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর ৮৯.৫৮ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৯২.৪২, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের এডিআর ৮৫.৫২, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এডিআর ৯০.৯৬ শতাংশ।

জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখপাত্র এ এস এম বুলবুল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার ব্যাংকের এডিআর কমাতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি। এর অংশ হিসেবে নতুন করে বড় কোনো ঋণ অনুমোদন দিচ্ছি না। আমানত বাড়াতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করি, অচিরেই এডিআর সীমা কমে আসবে।’

নতুন অনুমোদন পাওয়া মিডল্যান্ড ব্যাংকের এডিআর ৮৭.৭৩ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকের ৮৮.৫২ শতাংশ এবং ইউনিয়ন ব্যাংকের এডিআর ৯৩.৭৫ শতাংশ।