নারী আক্রান্ত বেশি নিজ ঘরে
স্বামীর নির্যাতনে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছেন হালিমা। ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে আছেন। ভালোবেসে পছন্দের পুরুষকেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের পরই বদলে যেতে থাকেন ভালোবাসার মানুষটি। তুচ্ছ কারণে শরীরে পড়ে উত্তপ্ত চামচের ছ্যাঁকা।
নিয়মিত মারধরে গোটা জীবনটাই দুঃসহ হয়ে গেছে। স্বামীর প্রতি ভালোবাসাও অনেকটাই উবে গেছে। দুই সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে শুয়ে ভাবেন, এই মানুষটি কীভাবে বদলে গেল?
ওয়ান স্টপ ক্রাইসিসের বাইরে থেকেই হালিমার গোঙানি শোনা যাচ্ছিল। বারবার বলছিলেন, ‘ও মাগো মরে গেলাম...আর সহ্য করতে পারছি না’, ‘আমারে শেষ করে ফেলছে রে...তুই এভাবে আমাকে ভালোবাসার প্রতিদান দিলি?’
গবেষণা বলছে, স্বামীর পাশাপাশি বাবা এমনকি মা, ভাই, শ্বশুর-শাশুড়ি আবার সন্তানের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। গত দুই দশকে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্ব উদাহরণ মানলেও এর মধ্যেই ধুঁকছেন কোটি কোটি নারী।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের গবেষণা বলছে, পুরুষতন্ত্রে প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে, নারী ঘরেই নিরাপদ। অথচ এই সহিংসতার বেশির ভাগ হয় বাড়িতেই। ঘরের প্রতি তিনজনের মধ্যে দুজন নারীই নানাভাবে পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হন।
বিবাহিত নারীদের ৮২ শতাংশই স্বামীর হাতে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ১২ হাজার ৫৩০ জন নারীর ওপর পরিচালিত এক জরিপে এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে বিবাহিতদের মধ্যে গ্রামের নারীরাই বেশি নির্যাতিত হন। আবার বয়স অনুযায়ী নির্যাতনের হার পাল্টাতে থাকে বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বিবিএস বলছে, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরাই নিপীড়নের শিকার হন বেশি।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, নির্যাতনের কারণে তারা আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন। বিবাহিত এসব নারীর ৫৬ শতাংশেরই বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে।
এর আগে ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো এক জরিপে বিবাহিত নারীদের ৮৭ দশমিক ১ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন বলে জানায় বিবিএস। এবারের প্রতিবেদন বলছে, সামগ্রিকভাবে দেশে নারী নির্যাতনের হার কমেছে। স্বামী বা যেকোনো সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতনের হারও কমেছে। আগে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এখন তা ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। এদের মধ্যে সঙ্গীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কারণে নির্যাতনের শিকার ১৫ শতাংশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৬১ জন নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের দাবি, নারী-শিশু নির্যাতন আইনে দায়ের করা ৯৭ শতাংশ মামলায় সাজা হয় না। আবার সংসারে টিকে থাকার জন্য ৯০ শতাংশ নারীই আইনের দ্বারস্থ হন না। সহিংসতার শিকার নারীদের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ পুলিশের সহায়তা চান। স্থানীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ করেন ২ দশমিক ১ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার মামলাগুলোর প্রতি পাঁচটির মধ্যে চারটিতেই আদালতে বিচার শুরু হতে লাগে দুই বছর। এসব কারণে সহিংসতার শিকার ৯৭ শতাংশ নারী বিচার পান না। বিচারহীনতার কারণে সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে।
২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের বা নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩১ হাজার ৬৬৯টি। এর মধ্যে ২০১০ সালে নারীর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে পাঁচ হাজার ৫৭০টি, ২০১১ সালে ছয় হাজার ৬১৬টি, ২০১২ সালে পাঁচ হাজার ৬১৬টি, ২০১৩ সালে চার হাজার ৭৭৭টি, ২০১৪ সালে চার হাজার ৬৫৪টি এবং ২০১৫ সালে চার হাজার ৪৩৬টি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানিয়া হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঘর এমন জায়গা, যেখানে নির্যাতন করলে কেউ দেখতে পায় না। তার নির্যাতনের ধরনটাও ভয়াবহ হয়। ঘরের নির্যাতন মেয়েরা বাইরে প্রকাশও করতে চান না। তাই তারা দিনের পর দিন নীরবে সহ্য করে যান। বলার সুযোগ পান না।’
পারিবারিক সহিংসতার বিচারের ব্যাপারে এই শিক্ষক বলেন, ‘যে দেশে খুন করলেও সেটার বিচার হয় না, সেখানে নারীর প্রতি সহিংসতা একটা সাধারণ বিষয়। থানা-পুলিশ এবং আদালতে কোনো সুস্থ মানুষ যেতে চায় না। সহিংসতার যেসব ঘটনা প্রকাশ পায়, মামলা হয়; সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনি জটিলতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ সহায়তা না পাওয়ার কারণে মামলা কম হয়। হলেও তা খুব একটা আলোর মুখ দেখে না।’
‘শুধু স্বামী নন, শ্বশুরবাড়ির পরিবেশের কারণেও মেয়েটি নির্যাতিত হয়। পারিবারিক পরিবেশ একটা গুরুত্ব বহন করে। নিজের পরিবারে যদি নারী-পুরুষ বৈষম্য থাকে, তাহলে সেই পরিবারের ছেলেটি নারীকে অবহেলার চোখে দেখতে থাকে।’
বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের সভাপতি রওশন আরা রুশো ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নিজ পরিবারে কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে এই নিকৃষ্ট সমাজব্যবস্থাই দায়ী। কারণ, নিজের পরিবার হলো নারীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সেখানে তারা নির্যাতনের শিকার হবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’