‘আলগা হচ্ছে’ পরিবারের বাঁধন

দীপান্বিতা রায়
 | প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪৪
প্রতীকী ছবি

নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মেয়েটির। স্বামীর বয়স ২৫, ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে। প্রেমের সম্পর্কের পরিণতি দিতে নিজেরাই করেন বিয়ে। তাদের জেদ দেখে মানতে বাধ্য হয় পরিবার।

কিন্তু যত দিনের প্রেম, বিয়ে টেকেনি তত দিনও। আট মাসের মাথায় মেয়েটি বাবার বাড়িতে চলে আসে বিধ্বস্ত অবস্থায়। শুরুতে কিছু না বললেও পরে জানায়, স্বামীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে পারছিল না সে। এরপর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। মেয়েটিই পাঠায় তালাকনামা।

গোপালগঞ্জের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার বনিবনা হচ্ছিল না স্বামীর সঙ্গে। তিনটি সন্তান হওয়ার পরও বিচ্ছেদ করেছেন স্বামীর সঙ্গে। কারণ, তার মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণ হচ্ছিল না।

পরিবারের বন্ধন আলগা হচ্ছে, বলছে সরকারের পরিসংখ্যানও। আবার তালাকের আবেদন বেশি আসছে নারীর দিক থেকে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি ১০০ জন বিবাহিত পুরুষের মধ্যে ১.৫ বিপতœীক বা তালাকপ্রাপ্ত অথবা তারা নিজেরা তালাক দিয়েছেন।

নারীদের ক্ষেত্রে এই হার ছয় গুণেরও বেশি। স্বামী পরিত্যক্তা/তালাকপ্রাপ্ত বা আলাদা বসবাস করছেন ১০ দশমিক ৫ শতাংশ নারী।

অর্থাৎ পুরুষেরা বিবাহবিচ্ছেদের পর দ্রুত আবার বিয়ে করেন। আর নারীরা এটা করেন না। নতুন সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি রক্ষণশীল থাকেন।

আবার বিবিএসের জরিপ বলছে, তালাকের হার আগের বছরেরগুলোর চেয়ে বাড়ছে। পাঁচ বছরে বিপতœীক স্বামীর সংখ্যা বেড়েছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। আর বিচ্ছেদ করা স্ত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ২ শতাংশ।

বিচ্ছেদের যত কারণ

বিবিএসের গবেষণায় বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো ভরণপোষণ দানে ব্যর্থতা, দাম্পত্য জীবন পালনে ব্যর্থতা, দুরারোগ্য ব্যাধি, প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়ার আগেই বিয়ে, না বলে উধাও হয়ে যাওয়া, কারাদ-, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, দুশ্চরিত্র, যৌতুক, পুনর্বিবাহ, সন্তান না হওয়া ও পুরুষত্বহীনতা।

জাতীয় মহিলা পরিষদ তালাকের কারণ হিসেবে চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো যৌতুক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্বামীর পরনারীতে আসক্তি।

স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন এমন কিছুসংখ্যক পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তালাক দেওয়ার কারণ হিসেবে সাধারণত তারা স্ত্রীর ‘চরিত্রের দোষ’কেই দায়ী করেছেন।

তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, পরপুরুষ বা পরনারীতে আসক্তির অভিযোগ বাড়ছে।

মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীশিক্ষার হার বাড়ার কারণে নারীরা স্বনির্ভর হয়ে উঠছে, বাড়ছে তাদের মধ্যে সচেতনতা। তাই সংসারে তারা আর স্বামীর একচ্ছত্র আধিপত্য মেনে নিতে চাইছে না। মুখ বুজে মেনে নিতে চাইছে না বৈষম্যমূলক আচরণ। সংসারে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার চেয়ে বিচ্ছেদকেই তারা উপযুক্ত বলে মনে করছে।

আবেদন বেশি নারীর পক্ষ থেকে

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তালাকের আবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ আবেদনই আসে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। অন্য নারীর সঙ্গে স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সামাজিক বন্ধনমুক্ত থাকার প্রবণতাসহ বিভিন্ন কারণে উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান ও বনানীর অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও বিত্তবান নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। আবার দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার এলাকার পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দেন।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘নিজেরা করি’র প্রধান নির্বাহী খুশি কবির ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘নারীরা আগের চেয়ে বেশি সচেতন হচ্ছে। তারা আইনি অধিকার সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখে। আগে যেমন অনেক কিছুই তারা মুখ বুজে মেনে নিত, ঘরে বন্দি হয়ে নির্যাতিত হতো, এখন আর তাদের মধ্যে সেই হীনম্মন্যতা নেই। তারা নিজেকে বুঝতে শিখেছে, চিনতে শিখেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমাদের সমাজে মূল্যবোধকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার অভাব ঘটেছে। পাশাপাশি মানবিক সম্পর্ক ক্রমেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষের মধ্যে প্রবেশ করছে লোভ-লালসা। বিবাহবন্ধনকে মানুষ আত্মিক সম্পর্ক হিসেবে না নিয়ে, তারা এটাকে একটা লাভজনক চুক্তি হিসেবে নিচ্ছে। যার কারণে নারী-পুরুষ উভয়েই নিজের লাভের দিকটা চরিতার্থ করতে গিয়ে অসংগতি হতেই ধৈর্যচ্যুত হয়ে সেই সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে।’

পরিসংখ্যান কী বলছে?

বিবিএসের ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ’ নামের প্রতিবেদন বলছে, দেশে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেড়েছে। এ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরাই বেশি এগিয়ে।

২০১৬ সালে বিপতœীক/তালাকপ্রাপ্ত/বিয়ে বিচ্ছিন্ন করা পুরুষের হার ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। পরের বছর সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৮ সালের চূড়ান্ত হিসাব এখনো আসেনি।

অন্যদিকে স্বামী পরিত্যক্তা/তালাকপ্রাপ্তা/পৃথক বসবাসকৃত নারীর সংখ্যা ১০ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ১০ শতাংশ। পাঁচ বছরে এই হার বেড়েছে শতকরা ২ শতাংশ।

বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী বিবাহিত নারী ও পুরুষের হারও বেড়েছে। ২০১৭ সালের সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, পুরুষ জনসংখ্যার ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ বিবাহিত, ২০১৬ সালে যা ছিল ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ।

২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী নারী জনসংখ্যার ৬৩ দশমিক ৩ শতাংশ বিবাহিত। ২০১৬ সালে যা ছিল ৬৩ দশমিক ১ শতাংশ।

পুরুষের বিয়ের গড় বয়স কিছুটা কমেছে। ২০১৭ সালের জরিপে গড় বয়স পাওয়া যায় ২৫ দশমিক ১ বছর। ২০১৬ সালে তা ছিল ২৫ দশমিক ২ বছর। নারীদের বিয়ের গড় বয়স আগের মতোই রয়েছে, তা হচ্ছে ১৮ দশমিক ৪ বছর।

বিবিএসের প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্বে থাকা এমএসভিএসবি প্রকল্পের পরিচালক এ কে এম আশরাফুল হক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের তথ্য সংগ্রহকারীরা প্রত্যেকেই নারী। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। ফলে নির্ভুল তথ্য পাচ্ছি আমরা। আর এতে সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে এসেছে। এর ওপর সমাজবিজ্ঞানীরা কাজ করবেন।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :