উচ্ছেদ মানে সরকারি অর্থ অপচয়

সৈয়দ ঋয়াদ ও কাজী রফিক
 | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৫৩

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি। আইন অমান্য করে স্থাপনা তৈরির বিরুদ্ধে শুরু হয় রাজউকের বড়সড় অভিযান। আবাসিক ভবনে গাড়ি পার্কিং না থাকা এবং বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় মিরপুরের কাজীপাড়ার ১৯ ভবন মালিককে। তবে পরিবর্তন আসেনি মিরপুর এলাকার রোকেয়া সরণি এলাকার ভবন মালিক ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে। ভবনগুলো আগের মতোই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অবৈধভাবে। কিন্তু এতে সরকারের কোষাগারে এক পয়সাও জমা হচ্ছে না।

সেই অভিযানে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল রোকেয়া সরণির ‘উড আর্ট ফার্নিচার’ শোরুমের ভবন মালিক কে এম শাজাহানকে। ঘটনার পর ভবনটির নিচতলার অর্ধেক অংশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উড আর্ট ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে পার্কিং করার জায়গা এখনো তৈরি করা হয়নি।

কাজীপাড়া লাইফ এইড হাসপাতাল, ফার্নিচারের দোকানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার আওতায় আনা হয়েছিল, তার একটিও পার্কিং সুবিধার আওতায় আসেনি। স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জরিমানা তো করল দেখলাম। আমাদের সামনেই জরিমানা করছে। কারও পার্কিং নাই, গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, তাই জরিমানা করছিল।’

‘কিন্তু লাভ হয়েছে কী? জবাবে বলেন, ‘কেউ তো পার্কিং বানায় নাই। সব আগের মতোই আছে। যে টাকা জরিমানা করছে, তাতে মালিকদের কিছুই মনে হয় নাই।’

২০১৭ ও ২০১৮ সালে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অভিযানে জরিমানাসহ শাস্তির আওতায় আনা হয় দায়ীদের। কোথাও ভেঙে দেওয়া হয় অপরিকল্পিত, অনুমোদিত ও অবৈধ স্থাপনা। তবে ঘটনার বছর পার হতে না হতেই আবারও সেই পুরনো চেহারাই দেখা গেছে রাজধানীর অধিকাংশ উচ্ছেদকৃত স্থাপনার। বারবার অভিযান চালানো হলেও পুরনো দশা ফিরছে রাজধানীর। আর অনিয়মের ছায়াতলেই থেকে যাচ্ছে সরকারি জমি, আবাসিক-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাহলে সরকারের টাকা খরচ করে এ ধরনের অভিযানে কী লাভ? বরাবর অভিযানের সময় এই বিষয়টি সামনে এলে ম্যাজিস্ট্রেটরা বলেন, তারা এখন থেকে নজরদারি করবেন। পরে একই অপরাধ হলে ব্যবস্থা হবে আরও কঠোর।

নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, “প্রশাসন চলবে শক্ত হাতে। ঢিলেমি দিলেই এটা অব্যবস্থার দিকে চলে যাবে। সেটাই হচ্ছে। তারা যদি মনে করে, ‘আমি ঢিলেমি দিয়ে চলব, যা হওয়ার হোক’ অথবা ভাবে এটা ক্ষমতার বাইরে, তাহলে তো সঠিক কাজটা হবে না। প্রধানমন্ত্রী যেখানে তাদের বলেছেন, ঠিকভাবে কাজ করেন, সেখানে তাদের আর কিসের ভয়?”

অভিযানের সুফল নেই

এক বছর আগে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকার রাস্তার মাঝখানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়। কিন্তু ওই এলাকার একদিকে মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের তিন নম্বর গেটের সামনে ও পিডব্লিউভি স্টাফ কোয়ার্টারের বিপরীতে উচ্ছেদের জায়গা আবারও দখল হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, সর্বশেষ উচ্ছেদ অভিযানে ভাঙা হয়েছিল এর সবকিছুই। ঘটনার এক মাস না ঘুরতেই আবারও দখলদারদের কবজায় চলে যায় জায়গাটি। বসানো হয়েছে মোটর গ্যারেজ, কোথাও কোথাও রাস্তার প্রায় ২০-৩০ ফুট জায়গাজুড়ে ফেলে রাখা হয়েছে অকেজো গাড়ি। কেউ লোকাল বাসের পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহার করছে জায়গাটি।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হাই বলেন, ছয় মাস, এক বছর পর পর ভাঙে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা কখনো প্রশাসনের সহযোগিতায় দখল করে নেয় খালি এসব জায়গা। বেশির ভাগ সময়ই উচ্ছেদের পর এক মাস পরই আবার দখল হয়ে যায় এসব জায়গা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। অভিযানে উদ্ধার হয় গাবতলী গরুর হাট থেকে দ্বীপনগর পর্যন্ত দখলকৃত সরকারি সম্পত্তি। সে সময় বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে দখলে থাকা বেড়িবাঁধের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি উদ্ধার হয়।

দখলে থাকা সরকারি এসব জমি উদ্ধারের পর অবশ্য বেশি দিন খালি পড়ে থাকেনি। দখলমুক্ত করার মাস দুই পরই আবার সেই পুরনো অবস্থায় ফিরে যায় গাবতলী পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি এসব জমি।

বেড়িবাঁধের পশ্চিম দিকের ফাঁকা জায়গায় ফের গড়ে উঠেছে ইট, পাথর বিক্রির গদি। আর পূর্ব দিকে বালুর গদি। এ ছাড়া অবৈধ দখলের অভিযোগে ভেঙে দেওয়া দ্বীপনগর এখন ভাড়া দেওয়া হয়েছে ইট-পাথরের কারবারিদের কাছে।

অভিযোগ আছে, ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অনুমতিতেই কারবারিরা উদ্ধারকৃত জমিতে পুনরায় ফিরে এসেছেন। কাউন্সিলর মারা যাওয়ার পর তার ছেলে সাজুর কাছে মাসিক হারে চাঁদা দিয়েই গদিগুলো চলছে। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রয়াত কাউন্সিলর আবুল হোসেন নিজেই এই উচ্ছেদ কমিটির প্রধান ছিলেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, রাহাত এন্টারপ্রাইজ, এরশাদ এন্টারপ্রাইজ, আদনান ট্রেডার্স, হায়দার আলী এন্টারপ্রাইজ, মোহাম্মদ আলী এন্টারপ্রাইজ, নুসরাত এন্টারপ্রাইজ, মেহরাব এন্টারপ্রাইজ, রোজিনা এন্টারপ্রাইজ, হেনা এন্টারপ্রাইজ, আনোয়ার এন্টারপ্রাইজ, নাহিয়ান এন্টারপ্রাইজ, মুসরাত এন্টারপ্রাইজ, মা এন্টারপ্রাইজ, ইকরা এন্টারপ্রাইজ, টু-স্টার এন্টারপ্রাইজ, রুহানী এন্টারপ্রাইজ, একতা ট্রেডার্স, মৈত্রী ট্রেডার্স, আদিব এন্টারপ্রাইজ, রাফসান এন্টারপ্রাইজ, এবিএম কোং, জননী এন্টারপ্রাইজ, জুয়েল এন্টারপ্রাইজ, রাজধানী এন্টারপ্রাইজ, রোহান নির্মাণ সেন্টার, নূর এন্টারপ্রাইজ, এবিসি এন্টারপ্রাইজ, মারিয়া এন্টারপ্রাইজ, লিমান এন্টারপ্রাইজ, নূর এ মদিনা এন্টারপ্রাইজ, আরিফা এন্টারপ্রাইজ, রুবেল এন্টারপ্রাইজ, কাজী এন্টারপ্রাইজ, মেট্রো ইনস্ট্রাকশন, মীম এন্টারপ্রাইজ, জুয়েল এন্টারপ্রাইজ, লাইজু এন্টারপ্রাইজসহ ৫০ থেকে ৬০টির মতো ইট, পাথর ও নির্মাণসামগ্রী বিক্রির গদি বসানো হয়েছে এই স্থানে।

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক গদি মালিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা করার জন্য বড় জায়গা দরকার। এই জায়গাটা বড়, আমরা অনেক বছর ধইরা এইখানে ব্যবসা করতাছি। একবার সরাইয়া দিছে। আমরা আবার অনুমতি নিয়াই বসছি। আমরা এইখানে মাগনা বসি নাই। সবাই টাকা দিয়াই বসছি।’

ব্যবসায়ীদের তথ্য বলছে, উচ্ছেদ কমিটির প্রধান এবং প্রয়াত কাউন্সিলর-পুত্র সাজু টাকার বিনিময়ে সরকারি জায়গায় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার অনুমতি দিচ্ছেন। সাজুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মুঠোফোনে বারবার ফোন করা হলেও নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

আবার ব্যবসায়ীদের নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের জন্য প্রতিদিন প্রায় হাজারের বেশি ট্রাক অপেক্ষমাণ থাকে বেড়িবাঁধের দুই পাড়ে, যা মূল সড়কের অনেকটাই দখল করে রাখে। আর এই দখলের মূল হোতা আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি তুফান (তুফানী)।

মিরপুর ১২ নম্বরের ধ-ব্লকে পার্কিং না থাকায় চার লাখ টাকা জরিমানা গোনার পরও সংশোধন হয়নি মিরপুর আধুনিক হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এক বছর আগের মতোই আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার চলছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমাদের তো নিজস্ব পুলিশ নাই। ফলে আমরা উচ্ছেদ করলেও রক্ষা করতে পারি না। স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়, কখনো প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে জায়গাগুলো দখল হচ্ছে।’

তাহলে সিটি করপোরেশনের কি কিছুই করার নেই?Ñএমন প্রশ্নে জামাল মোস্তফা বলেন, ‘যেসব এলাকায় খেলার মাঠ নেই, সেখানে খেলার মাঠ তৈরি করা। ফুটপাত নির্মাণ করা হবে। তাই আমাদের উচ্ছেদ অভিযানও নিয়মিত চলবে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা সাঈদ নূর আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘রাজধানীর যেসব এলাকায় রাজউক তাদের অভিযান পরিচালনা করেছে এবং বেদখল থাকা সরকারি সম্পত্তি পুনর্দখল করেছে, সেগুলোর ধরন অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। এর মধ্যে পার্ক, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার, ফুটপাত নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।’

ব্যতিক্রম কম

গত বছরের উচ্ছেদ অভিযানের পর রাজধানী মিরপুরের পল্লবী ও মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের চিত্র অবশ্য অনেকটাই বদলে গেছে। উচ্ছেদ অভিযানের পর নকশা মেনেই নিজেদের বাড়ি ঠিক করে নেন ওই এলাকার বাসিন্দারা।

এই এলাকার ১১ নম্বর সেকশনের ৫ নম্বর অ্যাভিনিউতে উচ্ছেদে দখলমুক্ত করা হয় প্রায় ৬০ হাজার বর্গফুট জায়গা। ২০১৮ সালের জুন মাসে উচ্ছেদ অভিযানে দখলমুক্ত হওয়া এই জায়গাটি এখনো খালিই পড়ে আছে। তবে স্থানীয়দের মতে, এই জায়গা নিয়ে আছে নানা দেনদরবার।

স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, উচ্ছেদ করা অংশে বেশ কিছু জমি ছিল। তবে অনেকেই জমির মালিকানা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি করে আসছিলেন। বিষয়টি নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও ছিল। মামলা চলমান অবস্থাতেই এখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়।

স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, যারা জমির মালিক রয়েছেন এবং এই জমিতে যাদের বসতি ছিল, তাদের অন্যত্র পুনর্বাসিত করার কথা চলছে। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, সেকশন ১১-এর সি ও ডি ব্লকের কোথাও একটিও খেলার মাঠ নেই। অপরিচ্ছন্ন ও নর্দমায় পরিণত হওয়া এই মাঠেই বিকেলে খেলতে দেখা গেছে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের।

গত মেয়াদে এই এলাকার সাংসদ এই খালি জায়গাটিকে এলাকার ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠ করার ঘোষণা দেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও চান উচ্ছেদকৃত জমিটিকে একটি আধুনিক খেলার মাঠে রূপ দেওয়া হোক।

মিরপুর ১২ নম্বর সেকশন এলাকায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উচ্ছেদ অভিযানের পর বোধোদয় হয়েছে বাড়ির মালিকদের। আবাসিক ভবনে গাড়ি পার্কিং না থাকার কারণে জরিমানা গুনে তারা নিজেদের শোধরে নিয়েছেন।

বাড়ির সামনের অংশে অবৈধভাবে বর্ধিত বারান্দা অপসারণ করানো বাড়িগুলোর কোনোটির বারান্দা বাড়ির মূল সীমানার বাইরে আসেনি। আবাসিক ভবনে কোচিং সেন্টার থাকার কারণে ৫ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাসার ভবন মালিককে জরিমানা করেছিল রাজউক। ওই ঘটনার পর কোচিং সেন্টারটি এখান থেকে সেকশন-১ নম্বরে স্থানান্তরিত হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :