ট্রাক উল্টে নিহত ১৩

হাড়ভাঙা খাটুনির পর আয়েশ ছিল খড়ের বিছানা

মাসুদ আলম, কুমিল্লা
 | প্রকাশিত : ২৭ জানুয়ারি ২০১৯, ০৯:০৪

ছোট্ট একটা ঘর। চারপাশে ইট। ওপরে টিনের ছাউনি। তা-ও স্থায়ী নয়। ওপরে ইটচাপা দিয়ে রাখা, যেন বাতাসে উড়ে না যায়। ওই ঘরের মেঝেতে খড় বিছিয়ে থাকতেন ১৮ জন শ্রমিক। তারা মৌসুমি শ্রমিক। ইট পোড়ানোর কাজ করতে নীলফামারীর জলঢাকা থেকে এসেছিলেন কুমিল্লায়। কে অ্যান্ড কো. ইটভাটায়।

আশা ছিল কাজ শেষে টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু তাদের ১৩ জনের ভাগ্যে তা আর হলো না। নিথর হয়ে ফিরতে হলো তাদের।

গত শুক্রবার কয়লার ট্রাক উল্টে ১৩ শ্রমিকের মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে এসেছে শ্রমিকদের মানবেতর জীবন। সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতের ঘুমেও ছিল না ন্যূনতম আয়েশ। নিরাপদও ছিল না জীর্ণ আবাসটি।

দুর্ঘটনার পর ইটভাটার শ্রমিকদের নানা বিষয় সামনে আসছে। সামান্য মজুরিতে কঠোর পরিশ্রমের বিষয়টিও এত দিন আড়ালেই ছিল। শুধু কে অ্যান্ড কো. ব্রিকফিল্ডেই নয়, কুমিল্লার সব কটি ইটভাটায় শ্রমিক-জীবন এমনই। অথচ ভাটার মালিকদের এ নিয়ে ভাবান্তর ছিল না কখনোই। বরং তারা দায় চাপাচ্ছেন শ্রমিক সংগ্রহকারী সরদারের ওপর। আর সরদার বলছেন, শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব ভাটা মালিকদের। তারা দায়সারাভাবে এই দায়িত্ব পালন করেন।

ভাটার অন্য শ্রমিকেরা জানান, এক হাজার কাঁচা ইট পোড়ানোর জন্য তৈরি করে দিতে পারলে ১৫০ টাকা পান তারা। শ্রমিক মনির হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার সারা দিন কাজ করেছেন নিহত শ্রমিকেরা। শুক্রবার পুরো সপ্তাহের বেতনের টাকা পেয়ে বাড়িতে পাঠাতে চেয়েছিলেন তারা।

জানতে চাইলে কুমিল্লার কে অ্যান্ড কো. ইটভাটার স্বত্বাধিকারী আবদুল রেজ্জাক বলেন, ‘ব্রিকফিল্ডে শ্রমিকের প্রয়োজন হলে আমরা সরদারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি শ্রমিক সংগ্রহ করে দেন। তারা কোথায়, কীভাবে থাকত, সে বিষয়ে আমি জানি না।’

তবে শ্রমিকদের নেতা (সরদার) সাদ্দাম হোসেন বললেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা ভাটা কর্তৃপক্ষ করে থাকে। অথচ মালিকরা দায়সারা একটা ব্যবস্থা করে দিয়েই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন।’

ট্রাক উল্টে যে ঘরের ওপর পড়েছিল, তার অবস্থা খুবই নাজুক। ঘর তৈরিতে ব্যবহৃত ইটগুলোও ছিল খুবই দুর্বল। তবে এ দায় নিতে নারাজ ভাটার মালিক আবদুল রেজ্জাক। উল্টো দায় চাপাচ্ছেন ট্রাকচালক ও হেলপারের ওপর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতটুকু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ট্রাকচালক ও হেলপারের অবহেলা ছিল।’

গত শুক্রবার কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের নারায়ণপুর এলাকায় কে অ্যান্ড কো. ইটভাটায় ট্রাক উল্টে ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিকের করুণ মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে সাতজন একই বাড়ির। তাদের সবার গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকায়।

এ ব্যাপারে কুমিল্লার পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ খুঁজে দেখতে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহ আল মামুনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পলাতক থাকা চালক ও হেলপারকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে পুলিশ। তবে এ ক্ষেত্রে ইটভাটা কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, তা-ও দেখা হবে।’

১৩ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় নিহত রঞ্জিত চন্দ্র রায়ের ভাই সঞ্জিত চন্দ্র রায় বাদী হয়ে চৌদ্দগ্রাম থানায় ট্রাকের চালক ও হেলপারের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। চালক ও হেলপার পালিয়ে আছেন।

জানতে চাইলে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক আবুল ফজল মীর বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবিকে। আশা করি, সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :