ঐক্যফ্রন্টে ভাঙনের সুর

বোরহান উদ্দিন ও এম গোলাম মোস্তফা
 | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩৫
ফাইল ছবি

চার মাস যেতে না যেতেই বিএনপির নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ভাঙনের সুর। বিএনপির আগের জোট ২০ দলের নেতারা আগে থেকেই ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের পছন্দ করছিলেন না। এখন বিএনপিও তাদের সন্দেহের চোখে দেখছে।

৩০ ডিসেম্বরের ভোটে জয়ী ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরামের দুই নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং মোকাব্বির খান সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে চাওয়ার কথা বলার পর বিরক্ত হয়েছে বিএনপি। কারণ, এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু মানতে নারাজ দলটি। আর তাদের বিজয়ীরা শপথ নেবেন না বলে জানিয়েছে দলটি।

এর মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনে ধানের শীষ নিয়ে জয়ী সুলতান মনসুর ও সিলেট-২ আসনে উদীয়মান সূর্য নিয়ে জয়ী মোকাব্বির খান বলছেন, ভোটারদের সম্মান রাখতে সংসদে যাবেন তারা। ফলে এ নিয়ে জোটে শুরু হয়েছে কানাঘুষা।

বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত হয়েছেন বিএনপির নেতারা। তবে এ নিয়ে খোলাখুলি মুখ খুলতে আরও একটু সময় নিতে চান দলটির নেতারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য জমির উদ্দিন সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত হলে তখন মন্তব্য করা যাবে। তবে এখন যা শুনছি সেটা হলে ঐক্যফ্রন্টের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। কারণ, এমন তো কথা ছিল না।’

‘শপথ নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে তখন নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য থাকবে। দেখতে হবে শেষ পর্যন্ত কী হয়।’

বিএনপির নেতারা জানান, ভোটের আগেও কামাল হোসেনের ভূমিকা ও নানা বক্তব্য নিয়ে আপত্তি ছিল। কিন্তু জোটের স্বার্থে এ নিয়ে কথা বলেননি তারা। বিশেষ করে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়াই নিঃশর্ত নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কোনো শর্ত পূরণ না হওয়ার পরও নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন নেতারা।

বিএনপির চেয়ারপারসনের একজন উপদেষ্টা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অনেক আশা নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট করা হলো। কিন্তু একটা দাবিও কি মানা হয়েছিল? নির্বাচনে ঠিকই গেলাম আমরা। বলা হলো কারচুপি হলে আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়া হবে। কই আমি তো এখনো নেতাকর্মীদের সঙ্গে এলাকায় আছি। কর্মসূচি কোথায়?’

এই নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কে শপথ নিল আর কে নিল না, সেদিকে তাকানোর দরকার নাই। এই ফ্রন্ট কী করল সেদিকে তাকিয়েও লাভ নেই। বিএনপি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দিকে নজর দেক। এই শক্তিকে কাজে লাগানো দরকার।’

গত ১৩ অক্টোবর কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। ছোট দলের হলেও বিস্ময়করভাবেই জোটের প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন ড. কামাল হোসেন। আর দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি ভোটে আসে ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তে। যদিও নির্বাচনের ফলাফল তাদের জন্য হয়েছে বিপর্যয়কর।

বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের পাশাপাশি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে করা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখে। পরে জোটের সিদ্ধান্তে সব প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে যান।

ভোটের আগে আগে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে কামাল হোসেনের দেওয়া সাক্ষাৎকার নিয়ে বিএনপি বিব্রত হয়। তিনি সে সময় বলেন, জামায়াত নেতারা ধানের শীষে নির্বাচন করবেন জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টে যেতেন না।

ভোটের পর সংবাদ সম্মেলন করে কামাল হোসেন বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে কার্যত শর্ত বেঁধে দেন। এই বিষয়টিও বিএনপির নেতারা ভালো চোখে দেখছেন না।

১৯৯৯ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় বিএনপি। এর পর থেকে আওয়ামী লীগ নানাভাবে বিএনপিকে চাপ দিচ্ছে। কিন্তু ভোটের রাজনীতির কথা চিন্তা করে বিএনপি জামায়াতকে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। এ অবস্থায় কামাল হোসেন কেন এই বিষয়টি নিয়ে তৎপর হলেন, সেই বিষয়টি ভাবাচ্ছে বিএনপিকে।

ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী স্বয়ং তার দলের হয়ে ভোটে লড়া দুই নেতার সমালোচনা করছেন। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি নাই। ওনারা (নির্বাচিত দুজন সংসদ সদস্য) আকুল হয়ে গেছেন। আকুল হতেই পারেন। ওনারা তো শুধু গণফোরামের প্রার্থী নন, তারা ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী। সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে।’

৩০ ডিসেম্বরের ভোটকে কারচুপি আখ্যা দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের বিজয়ীরা শপথ নেবেন না বলেও জানিয়েছেন মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই জোটের বিজয়ী সংসদ সদস্য মোট আটজন। তাদের ছয়জন বিএনপির এবং দুজন গণফোরামের।

বিএনপি এরই মধ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও সরকারের অধীনে কোনো ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে তারা বর্জন করেছে শপথ অনুষ্ঠান।

তবে শপথ নেওয়ার সময় এখনো পেরিয়ে যায়নি। বিধান অনুযায়ী সংসদ প্রথম অধিবেশনে বসার ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নেওয়ার সুযোগ আছে। একাদশ জাতীয় সংসদ প্রথম অধিবেশনে বসতে যাচ্ছে আগামী বুধবার। সে হিসাবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সুযোগ আছে।

এর মধ্যে সুলতান মনসুর খোলাখুলি ঢাকা টাইমসকে বলেছেন, জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে সংসদে গিয়ে কথা বলার জন্য। আর নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ভোট পেয়ে কথা না বললে জনগণকে অবজ্ঞা করা হয়।

মোকাব্বির খান জানিয়েছেন, তিনিও শপথ নেওয়ার পক্ষে। তবে যেহেতু সময় আছে, তাই আরও অপেক্ষা করবেন।

দুই নির্বাচিত সংসদ সদস্যের এই অবস্থান জোটে কোনো ধরনের মতভেদ তৈরি করবে কি না, এমন প্রশ্নে সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘সেটা তো আপনিও বোঝেন, আমিও বুঝি। তবে আমরা এখনই শপথ নেব না, শপথ নিয়ে এই সংসদকে বৈধতা দেব না আমরা। তবে সময় আছে, ৩০ তারিখ যদি সংসদ বসে। সেদিন থেকে আরও ৯০ দিন সময় পাব শপথ নেওয়ার জন্য। সময় আছে, দেখা যাক। এখনো আমাদের শপথ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় নাই, আগেরটাই (শপথ নেবে না) বহাল আছে।’

ঐক্যফ্রন্টের আরেক শরিক জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত হলো শপথ না নেওয়া। তারা যদি (গণফোরামের দুজন) শপথ নেন, তবে আমরা যেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, সেটাই নেব। আমরা এই শপথ নেওয়ার পক্ষে না। শপথ নেওয়ার মানেই হচ্ছে, যে ভোট ডাকাতি হয়েছে তার বৈধতা দেওয়া। তারা যদি শপথ নেয়, তবে আমরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেব।’

জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের মধ্যস্থতাকারী গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের কেউ শপথ নেবে না, এটাই সিদ্ধান্ত। তার আগে যদি কিছু হয়ে থাকে, আমি জানি না। ঐক্যফ্রন্ট এখনো সংসদে যোগদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় নাই। আজ মনে হয় কামাল হোসেন আসবেন। ওনি এলে আমাদের মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে, ওই সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছু হবে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের দাবি, সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির শপথ নেবেন কি নেবেন না এ বিষয়ে তিনি জানেন না। এ সম্পর্কে তার ধারণা নেই।

‘আর শপথ নিলে ঐক্যফ্রন্টে কী প্রভাব পড়বে এ বিষয়টিও আমি বলতে পারব না’Ñএ বিষয়ে প্রশ্নে মোশাররফের জবাব ছিল এমন।

নির্বাচনের কয়েক দিন পর থেকে ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের কিছু বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সমালোচনা হয় বিএনপিতে। ড. কামাল হোসেনকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা বানানো ভুল ছিল বলে দাবি করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘আমরা শুধু অন্যদের নেতা বানিয়ে দিয়েছি। আমাদের বিএনপির অনেক সিনিয়র, যোগ্য, ক্যাপাবল নেতা আছেন। তাদেরকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম।’

বিএনপির আগের জোট ২০ দলের শরিক এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহদাত হোসেন সেলিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের এসব নেতার আচরণে আমরা প্রচ- ক্ষুব্ধ। বিএনপির কাঁধে ভর করে গণফোরাম সব থেকে বেশি লাভবান হয়েছে। এদের যত দ্রুত বিদায় করা যাবে, ততই বিএনপির জন্য ভালো।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজনীতি এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :