দুর্নীতির লড়াইয়ে দৃশ্যপটে দুদক

সাখাওয়াত প্রিন্স
| আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৫৩ | প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:১৮
ফাইল ছবি

হঠাৎ করে সরব হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলছে হুটহাট অভিযান। মিলছে অসংগতিও। এসব ক্ষেত্রে দুদক সরাসরি ব্যবস্থা নিতে না পারলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানিয়ে দিচ্ছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে দোষীদের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দুদকের অভিযান বেশ সাড়া ফেলেছে। হাসপাতালে বেড়েছে চিকিৎসকদের উপস্থিতি। অভিভাবকদের কাছ থেকে নেওয়া অতিরিক্ত ফি ফেরত দিতে বাধ্য হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বেরিয়ে এসেছে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মচারীদের হাজার কোটি টাকার সম্পদ। উদ্ধার হয়েছে বন বিভাগের জমি। উচ্ছেদ হয়েছে সরকারি খাসজমির দখল। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অবৈধ ইটভাটা।

দুর্নীতি ঠেকাতে তৎপর সংস্থাটির হঠাৎ এই সরব ভূমিকায় নড়েচড়ে বসেছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুদক যেসব অভিযান পরিচালনা করেছে, তার কোনোটাই বিশেষ নয়। এটি নিয়মিত কাজের অংশ। এ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দুদকের হঠাৎ সরব হওয়ার পেছনে এই বিষয়টিও ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া নতুন মন্ত্রিসভা শপথ নেওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে সরকারি চাকুরেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকেও চিকিৎসক ও নার্সদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।

দুদক সূত্র জানায়, দুদকের হটলাইন ‘১০৬’ ধীরে ধীরে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। প্রতিদিনই কম-বেশি অভিযোগ আসছে ফোনে। সেই তথ্য ধরে দুদকের দল ছুটছে দুর্নীতির খোঁজে। সাম্প্রতিক ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে অভিযান বেশ আলোচিত। এই অভিযোগটিও সংস্থার কাছে এসেছে হটলাইনে। অভিযোগ পাওয়ার পর, ঢাকার একাধিক হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে দুদক যে চিত্র দেখেছে, তাতে হতাশাই বেশি। হাসপাতালে রোগী থাকলেও চিকিৎসক নেই। পরে সারা দেশেই বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অভিযানে ফুটে উঠেছে চিকিৎসকদের দায়িত্বহীনতার ছবি।

অভিযানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালে ছিলেন না ৪০ ভাগ চিকিৎসক। ঢাকার বাইরে হাসপাতালে না যাওয়া চিকিৎসকদের সংখ্যা আরও বেশি। সাত জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩১ জন চিকিৎসকদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন ৮১ জন, যা শতকরা প্রায় ৬২ শতাংশ।

এ ছাড়া সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারী আবজাল হোসেনের সম্পদের অনুসন্ধানেও বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দুদক সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের ভিত্তিতে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন দুদকের গোয়েন্দা দল। দুর্নীতির সলুকসন্ধানে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার ঘটনা ঘটেছে। সন্ধান মিলেছে ৩০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী আবজালের হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য। ঢাকার উত্তরায় পাঁচটি বাড়ি, জমি, অস্ট্রেলিয়াতেও আবাস গড়েছেন সরকারের চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারী। আবজালের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারে চলছে দুদকের অনুসন্ধান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে জানান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুদকের গোয়েন্দা দল নিয়মিত নজরদারি চালাচ্ছে। কোথাও দুর্নীতির আভাস পেলেই চলছে অনুসন্ধান। এ ছাড়া ১০৬-হটলাইনে আসা অভিযোগগুলোও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে অভিযান চালাচ্ছেন তারা। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘শুধু বাইরেই নয়, নিজেদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরও নজরদারি চালাচ্ছে দুদক। ইতিমধ্যে আসামির হাতে মামলার কাগজপত্র সরাসরি দেওয়ায় একজন কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

দুদকের আকস্মিক অভিযানে ‘দুদক আতঙ্ক’ তৈরি হয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তরে। সবাই সতর্ক হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। কখন দুদক আসে এই আতঙ্কে কাজে বাড়তি মনোযোগ দিয়েছেন সরকারের সেবা খাত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

দুদকের হটলাইনে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়ার বড় প্রমাণ মিলেছে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণে অতিরিক্ত ফি আদায়ের ঘটনা থেকে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, ১০৬ নম্বরে কল করে একজন অভিভাবক স্কুলগুলোর অতিরিক্ত ফি আদায়ের ব্যাপারে জানালে দুদক রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায়। ঘটনার সত্যতা পায়। পরে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উদ্ধার করে অভিভাবকদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ফি আদায়ের ব্যাপারে অনেক সতর্ক হয়েছে।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন কার্যালয় থেকে কুড়িজনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পায় দুদকের গোয়েন্দা বিভাগ। গত ২৩ জানুয়ারি গোয়েন্দারা এসব কর্মকর্তার বিষয়ে অবগত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে এবং তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত রেখেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। গত ২৩ জানুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন (ডিএসসিসি) বলধা গার্ডেন লাগোয়া প্রায় দুই হাজার বর্গফুট রাস্তা মিথ্যা তথ্য দিয়ে লিজ দেওয়ার অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। মামলায় ডিএসসিসির তৎকালীন প্রশাসক ও অতিরিক্ত সচিব খলিলুর রহমানসহ ৪৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।

রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে, এমন ব্যক্তিদের তালিকাও করছে দুদক। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের হলফনামা সংগ্রহ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের তথ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে যারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া যায়Ñতাদের তথ্য সংগ্রহও করছে কমিশন।

জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দুর্নীতির গন্ধ যেখানে আছে, আমরা সেখানে থাকব। প্রাক্তন মন্ত্রী বা বর্তমান বলে কথা নেই, আমরা সবাইকে একই পাল্লায় মাপতে চাই। অভিযোগ যদি থেকে থাকে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করব।’

দুদক নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোনো অভিযোগই আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা অভিযোগকে আমাদের কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছি। দুদক যেসব আকস্মিক অভিযান পরিচালনা করে, তাতে দেখবেন দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয় না বরং সতর্ক করা হয়। এসব অভিযান সম্পর্কে আতঙ্ক হওয়ার কিছু নেই।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :