হাসপাতালে না গেলেও বেতন তুললেন ১৩ লাখ টাকা

মনোনেশ দাশ ও আজহারুল হক, ময়মনসিংহ
| আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫৮ | প্রকাশিত : ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩১

তিন দিনের ছুটি নিয়ে তিন বছর ধরে উধাও। এর মধ্যে গত ছয় মাস ধরে বেতন-ভাতা তোলেননি। তার আগের আড়াই বছর ঠিকই জনগণের করের টাকা নিজের আয়েশে ব্যবহার করেছেন। অঙ্কটা সব মিলিয়ে অন্তত ১৩ লাখ বলে নিশ্চিত করেছেন তার সহকর্মীরাই।

তিনি ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার। নাম আরিফুর রহমান। কর্মস্থল ময়মনসিংহের গফরগাঁও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কিন্তু এমন কোনো ইমার্জেন্সি তৈরি হয়নি, যা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পারে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিন দিনের ছুটিতে গিয়েছিলেন। এর পরের তিন বছর ধরে তার খোঁজ নেই।

সহকর্মীরা জানাচ্ছেন, আড়াই বছর আরিফুরের হিসাবে প্রতি মাসে বেতন-ভাতা, উৎসব ভাতা, বিনোদন ভাতাসহ এই সময়ে ঢুকেছে অন্তত ১৩ লাখ টাকা।

অর্থাৎ জনগণের সেবা না করে তাদের করের এই বিপুল পরিমাণ টাকা পকেটে পুরেছেন এই চিকিৎসক। এ নিয়ে তার যেমন কোনো ব্যাখ্যা নেই, তেমনি চিকিৎসা প্রশাসনের কেউ বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। একজন অনুপস্থিত মানুষের ব্যাংক হিসাবে কীভাবে টাকা গেল, এমন প্রশ্নে চুপ থাকা বা অস্বীকার করা বা ফোন না ধরাকেই কৌশল হিসেবে নিচ্ছেন চিকিৎসক আরিফুরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

চিকিৎসক আরিফুরের ফোন নম্বরটিও বন্ধ। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সারা দেশে সরকারি চিকিৎসকদের হাসপাতালে অনুপস্থিতি নিয়ে জনক্ষোভ রয়েছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়েও এ নিয়ে আছে আপত্তি। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন ১১টি হাসপাতালে গিয়ে ৪০ শতাংশ চিকিৎসককে কর্মস্থলে পায়নি। ঢাকার বাইরে এই হার ৬০ শতাংশ।

দুদকের অভিযানের পর এই ১১টি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের উপস্থিতি বাড়লেও যেসব হাসপাতালে দুদক যায়নি, সেগুলোর অবস্থা এমনই। দিনের পর দিন বহু চিকিৎসক কর্মস্থলে যান না। কিন্তু বেতন তোলার ক্ষেত্রে ভুল করেন না কেউ।

এর মধ্যে গফরগাঁও হাসপাতালের চিকিৎসক আরিফুরের মতো যত শত বা হাজার চাকুরে আছেন, তাদের চাকরি থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গফরগাঁও হাসপাতালেই এমন চিকিৎসক আরও আছেন। সার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডাক্তার আফরোজা ইসলাম ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর তিন দিনের ছুটি নেওয়ার পর আর হাসপাতালে আসেননি। কাজ না করে তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় লাখ টাকা বেতন-ভাতা তুলেছেন।

জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে, দায়িত্বে অবহেলা করে বেতন নেওয়া জালিয়াতি। এটা অবশ্যই দুর্নীতি। এটা কীভাবে সম্ভব হলো, সেটাই দেখার বিষয়।’

এর পেছনে চিকিৎসা প্রশাসনের অন্যরাও জড়িত বলেই বিশ্বাস করেন টিআইবির প্রধান। বলেন, ‘নিশ্চয় এককভাবে কেউ এ রকম দুর্নীতি করতে পারে না। কারও না কারও সুরক্ষায় তিনি এটা করতে পেরেছেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যে দুর্নীতি করেছে, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। একইভাবে তার সুরক্ষাকারীদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’

গফরগাঁও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি কে এম এহছান এ বিষয়ে বলেন, ‘দীর্ঘদিন কর্মস্থলে ডাক্তারদের অনুপস্থিতি খুবই দুঃখজনক। বিষয়টির বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। ডাক্তারের অনুপস্থিতির কারণে এলাকার গরিব, অসহায় রোগীদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা কোনো সরকারি কর্মকর্তার করা উচিত নয়।’

গফরগাঁও উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মঞ্জুর আহসান বলেন, ‘ওই ডাক্তার যে দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত, তা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আমাদের জানানো হয়নি। এর দায়দায়িত্ব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তাদেরই নিতে হবে।’

জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলম আরা বেগম দাবি করেন, যত দিন অনুপস্থিত আরিফুর, তত দিন তাকে বেতন পাঠানো হয়নি। যদিও হাসপাতালের অন্য চিকিৎসক এবং নথিপত্র বলছে, আড়াই বছর বেতন গেছে অনুপস্থিত চিকিৎসকের হিসাবে।

হাসপাতালে করুণ চিত্র

হাসপাতালের ১১ জন চিকিৎসকের দশাই কম-বেশি একই রকম। তারা হাসপাতালে আসেন যেদিন খুশি সেদিন। কেন আসেননি, সেই ব্যাখ্যাও দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না।

যোগদান করেই বদলি হয়ে যাওয়ায় উপজেলায় ৩৪টি পদের মধ্যে ১৪টি এমনিতেই শূন্য। চারজন প্রেষণে অন্যত্র চাকরি করেছেন। দুজন দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।

গত মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থান করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ তিনজনকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়। ডাক্তারদের নির্ধারিত কক্ষগুলো অধিকাংশই তালাবদ্ধ। কয়েকটি খোলা থাকলেও কামরাগুলোতে কেউ ছিল না। রোগীরা হাসপাতালে ডাক্তার না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শিশু বিভাগের মুশফিকুর রহমান, অর্থোপেডিক্সের মিজানুর রহমান, জরুরি বিভাগের নুসরাত জাহান ও নিয়ামুল হাসানকে।

পুরুষ ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ১০ জন ও নারী ওয়ার্ডে ছয়জন রোগী। তাদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালের খাবার ও ওষুধ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

হাসপাতালে গাইনি চিকিৎসক ও অবেদনবিদ নেই বলে অস্ত্রোপচার বন্ধ রয়েছে বলে জানান উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলম আরা বেগম।

হাসপাতালে অনুপস্থিতির ব্যাপারে জানতে চাইলে চিকিৎসা প্রশাসনের এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতি মাসে সব বিষয়ে ময়মনসিংহ সিভিল সার্জনের অফিসে প্রতিবেদন পাঠানো হয়। সেখানে অভিযুক্ত বিষয়গুলো উল্লেখ থাকে। সেই মোতাবেক সিভিল সার্জন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

তবে ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন এ কে এম আব্দুর রবকে মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।

হাসপাতালের কর্মীরা জানান, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ফ্লোরা আফরোজ, তপন কুমার দাশ, আমেনা খাতুন মিতা, নুসরাত জাহান, নিয়ামুল হাছান, অর্থোপেডিক্সের কনসালট্যান্ট মিজানুর রহমানসহ ১১ জন কর্মস্থলে অবস্থান না করে ঢাকায় অবস্থান করেন। যেদিন খুশি আসেন, যেদিন খুশি আসেন না। আর সপ্তাহে দুই দিনের বেশি কারও ডিউটি করার উদাহরণ নেই।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তপন কুমার দাশ ঢাকা টাইমসকে জানান, তিনি শনিবারে আসবেন। অর্থোপেডিক্সের কনসালট্যান্ট মিজানুর রহমান রবিবার ও বুধবার রোগী দেখেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আলম আরা বেগমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, অনুপস্থিতির কারণে বেশ কয়েকজন চিকিৎসককে শোকজ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :