ডাক্তারের ‘রোগ’ শিক্ষকদের মধ্যেও

প্রকাশ | ৩১ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:৪৫

নিজস্ব প্রতিবেদক

কেবল চিকিৎসক নন, সরকারি স্কুলে শিক্ষকরাও যে ব্যাপকভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, সেটি দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।

চারটি জেলার ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে এই অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ সময় ছয়টিতে প্রধান শিক্ষকরাই কর্মস্থলে ছিলেন না।

দুদকের এই অভিযানের দিন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়েও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এই ফাঁকিবাজি প্রতিরোধে কী করা যায়, এ নিয়ে কথাবার্তার মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়, স্কুলে বসবে বায়োমেট্রিক উপস্থিতি বাক্স। শিক্ষকরা স্কুলে এসে আঙুলের ছাপ দিয়ে জানাবেন উপস্থিতি। ফলে দেরি করলে বা না এলে তার রেকর্ড থাকবে।

যে চিত্র দেখেছে দুদক

সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিনিধিদল দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যায়। নির্ধারিত সময়ের আগেই অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী শূন্য দেখতে পায়। খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারে, শিক্ষকরা ইচ্ছামতো ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই সরকারি ও বেসরকারি অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দিয়ে শিক্ষকরা বাড়ি চলে যান।

গতকালও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রাঙামাটি, দিনাজপুর, ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকায় অভিযান চালিয়ে এই চিত্র দেখতে পায় দুদকের দল।

১৪টি স্কুলে অভিযানকালে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে কাঞ্চনডোব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রঘুনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গরিবপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বিন্নাগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং নবাবগঞ্জ মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকদের পাওয়া যায়নি।

গত ২১ জানুয়ারি দেশের আটটি জেলার ১১টি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে ৪০ শতাংশ চিকিৎসককে অনুপস্থিত থাকতে দেখে দুদক। হটলাইন ১০৬-এ ফোন পেয়ে এই অভিযান চালানো হয়।

হাসপাতালের অনুপস্থিতি নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও এসেছে হুঁশিয়ারি। এর মধ্যে হটলাইনে অভিযোগ পেয়ে দুদক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের অভিযান শুরু করেছে।

দুদক এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক মহাপরিচালক (প্রশাসন) মুনীর চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাজমান অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা দূর করতে দুদকের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের সমান্তরালে জনসাধারণকেও দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে নামতে হবে।’

বায়োমেট্রিক হাজিরা চালুর সিদ্ধান্ত

হাসপাতালে ডাক্তার আনতে এরই মধ্যে চিকিৎসালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা সিস্টেম চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ও মনে করছে, শিক্ষকদের ফাঁকি রোধের উপায়ও এই যন্ত্র।

বায়োমেট্রিক মেশিন কেনার জন্য প্রতিটি স্কুলে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে এই সভায়। এতে বলা হয়েছে, স্কুলের সরকারি ফান্ড থেকে স্কুল পরিচালনা কমিটি মেশিন কিনবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে প্রধানত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা চালু করার বিষয়ে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকের (বুধবার) সভায়।’

এর বাইরে মাঠ লেভেলের কর্মকর্তাদের তদারকি জোরদার করার নির্দেশনা এসেছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, হঠাৎ স্কুল পরিদর্শনে যাবেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে মন্ত্রণালয় থেকে ই-মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হবে। এতে করে ড্যাশ বোর্ডের মাধ্যমে সারা দেশের প্রাথমিক স্কুল মনিটরিং করা হবে। প্রতি মাসে শিক্ষা কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রতিবেদন পাঠাবে।

সচিব বলেন, ‘এছাড়া ই-মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা আকস্মিক স্কুল পরিদর্শন করবেন। যেসব শিক্ষক অনুপস্থিত থাকবেন তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

তবে ‘হাসপাতালের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা অতটা খারাপ নয়’ উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘যেটুকু সমস্যা আছে সেটুকুও সমাধান হয়ে যাবে। আমরা যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে আর সমস্যা থাকবে না।’

শিক্ষাবিদের বক্তব্য

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘হাসপাতালে যেসব কারণে চিকিৎসকেরা থাকেন না, সেই একই কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়েও শিক্ষকেরা থাকছেন না।’

কারণগুলো উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘এখানে প্রধান কারণ হচ্ছে জবাবদিহির অভাব। এখানে সরকারের যেমন জবাবদিহি নেই, তেমনি যারা কাজ করে তাদেরও জবাবদিহি নেই। সবার মধ্যেই একটি ফাঁকিবাজির অভ্যাস গড়ে উঠেছে।’

‘দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আরেকটি কারণ। এর সঙ্গে রয়েছে অনুকূল পরিবেশের অভাব। অর্থাৎ মফস্বলে থাকার পরিবেশ নেই। যিনি কাজ করেন, তিনি থাকতে চাইলে পরিবার থাকতে চায় না। আর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ। অর্থাৎ সব ক্ষমতার কেন্দ্র হচ্ছে রাজধানী। এ জন্য সবাই রাজধানীতে আসতে চায়।’

বিরাজমান সমস্যা থেকে মুক্তির বিষয়ে বিশিষ্ট এই অধ্যাপক বলেন, ‘জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করলে এই সমস্যা অনেকটা কেটে যাবে।’

স্কুলে উপস্থিতির নতুন সময় নির্ধারণ

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ক্লাস কার্যক্রমের নতুন সময়সীমা নির্ধারণ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

নির্দেশনা অনুযায়ী, রাজধানীর সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শীতকালীন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে সকাল আটটা থেকে পৌনে তিনটা পর্যন্ত। আর গ্রীষ্মকালীন সময়সূচি সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা সোয়া দুইটা।

আর মফস্বলে নয়টা থেকে বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতো সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে। নতুন এই নির্দেশনায় সময় বাড়ল ১৫ মিনিট।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম-আল-হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন করে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনায় সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন থেকে এ সময়ের আগে কোনো শিক্ষক বিদ্যালয় ত্যাগ করতে পারবে না।’