দুদককে ভয় পেতে শুরু করেছে দুর্নীতিবাজরা

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:০৩

সমাজ উন্নয়ন সূচকের নানা ক্ষেত্রে বেশ ভালো করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অর্থনীতিতেও এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে বলা হচ্ছে এশিয়ার টাইগার হিসেবে। দারিদ্র কমছে, মানুষের আয় বাড়ছে। এমনকি দুর্নীতিও কমছে। আমরা সাধারণ মানুষ সেটা টের পাচ্ছি। কিন্তু টিআইবি বলছে, দুর্নীতি ‘বাড়ছে’। টিআইবির এই মূল্যায়ন কতটা রাজনৈতিক আর কতটা গবেষণা-নির্ভর সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আমরা সাধারণ মানুষ দেখছি, ডিজিটাল নানা সেবা চালু করে দুর্নীতির রাস্তা একের পর এক বন্ধ করে দিচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার। বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আগের যে কোনো সময় থেকে বেশি তৎপর। দুদক নিয়ে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ভীতি তৈরি হচ্ছে। এই ভীতি আগে ছিল না। দুদক ক্রমেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করছে। পত্রিকা খুললেই দুদকের নানা সফল অভিযানের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন বছরে নতুন সরকার বলতে গেলে একের পর এক চমক উপহার দিচ্ছে।

গত জানুয়ারির ২৩ তারিখে এক খবরে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্নীতি ও ঘুষের টাকাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা যায়, ঘুষের টাকাসহ গ্রেফতার হয়েছেন কিশোরগঞ্জ ভূমি অফিসের সার্ভেয়ার গিয়াস উদ্দিন। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার সোনালী ব্যাংকের ভাটিয়া পাড়া শাখার কর্মকর্তা মো. আকতার হোসেন গ্রেফতার হয়েছেন জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের এক মামলায়। আর সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আমানুল্লাহ। বুধবার (২৩ জানুয়ারি) সকাল থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত পৃথক পৃথক জেলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়৷ দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জানা যায়, সকাল ১১টায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে ১০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার সময় সেখানে আগে থেকে ওত পেতে থাকা দুদকের একটি বিশেষ দলের কাছে হাতেনাতে গ্রেফতার হন ওই অফিসের সার্ভেয়ার মো. গিয়াস উদ্দিন।

এদিকে, ঋণ জালিয়াতি করে টাকা আত্মসাতের এক মামলায় কাশিয়ানির সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ভাটিয়া পাড়া শাখার কর্মকর্তা মো. আকতার হোসেনকে গ্রেফতার করে দুদকের অপর একটি বিশেষ দল। বিভিন্ন ভুয়া ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতির মাধ্যমে দুই কোটি ৫৫ লাখ সাত হাজার টাকা ঋণ দেখিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে কাশিয়ানি থানায় ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর দুদকের দায়ের করা এ মামলার মোট আসামি ছয়জন।

অপরদিকে, সরকারি চাল আত্মসাতের অভিযোগে বরিশাল সদর উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আমানুল্লাহকে বরিশাল শহরের চৌমাথা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে দুদকের একটি দল। তার বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলা ছিল। ওই মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ভিজিডি কার্ডধারী স্থানীয় ২৫১ জনকে ২০ কেজি করে কম চাল দিয়ে প্রায় পাঁচ মেট্রিক টন চাল আত্মসাৎ করেছেন তিনি। যার মূল্য এক কোটি ৮২ লাখ ৪২৬ হাজার টাকা৷ গত বছরের ২৭ নভেম্বর দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবুল হাসেম কাজী বাদী হয়ে আমানুল্লাহসহ দু’জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করেন।

অন্যদিকে আরেকটি সংবাদে জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা পরিচয়ে ঘুষ নেওয়ার সময় হাসান মুন্না ওরফে রফিক নামে এক প্রতারককে গ্রেফতার করেছে দুদক। ২৪ জানুয়ারি রাজধানীর নয়াপল্টনের গোন্ডেন প্লেট রেস্টুরেন্টে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে দুদক গোয়েন্দা ইউনিট।

একটি সংবাদে আমরা জেনেছি, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দেওয়ার সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছেন নীলফামারী জেলা আনসার কমান্ড্যান্ট আশিকুর রহমান। দুদকের উপ-পরিচালক লুৎফর কবির চন্দন বলেন, ঘুষ দেওয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়। ডবলমুরিং থানায় তার বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার অপরাধে মামলা হয়েছে। তাকে থানা পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।

দুদক জানিয়েছে, আশিকুর চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলা ছিল। সেই মামলা থেকে রেহাই পেতে চট্টগ্রামের এক দুদক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিতে যান তিনি। এ সময় দুদক তাকে ফাঁদ পেতে গ্রেফতার করে।

দুদক কোনো দুর্নীতিবাজকে গ্রেফতার করেছে, শুনলে আমাদের ভালো লাগে। জাতির পিতা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন যেখানে দুর্নীতি থাকবে না, সাধারণ মানুষ সহজে সেবা পাবে , নিজ মেধা ও শ্রমের শক্তিতে ভাগ্য বদলের চেষ্টা করার সুযোগ পাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দেশ দুর্নীতিবাজ সামরিক, বেসামরিক আমলা, লোভী ব্যবসায়ী আর চোরাকারবারিদের করায়ত্তে চলে যায়। দীর্ঘ অমানিশার পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মত প্রধানমন্ত্রী হলে দেশ আলোর মুখ দেখে। কিন্তু ২০০১ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে হারিয়ে দেয়া হয়। এরপর আবার অন্ধকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আবারো প্রধানমন্ত্রী হওন শেখ হাসিনা। সেই থেকে চলছে তাঁর জিহাদ। এই জিহাদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাস ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ গড়ার দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে শেখ হাসিনা জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। শেখ হাসিনা একা যা করার করছেন। পূর্ণভাবে সফল হতে গেলে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। আমরা বুঝতে পারছি, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তাঁর টানা তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও সক্রিয় করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমরা তাই সাফল্য দেখতে পাচ্ছি।

দুদক কদিন আগে এমন এক লোকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সামান্য কর্মচারী, কিন্তু হাজার কোটি টাকার মালিক! জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাবরক্ষক আবজাল হোসেনের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়া আবজাল ও তার স্ত্রীর সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করতে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তি জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এদিকে আদালতের নির্দেশনার পর সব সম্পদের তথ্য চেয়ে আবজাল হোসেনকে নির্দেশ দিয়েছে দুদক।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৃতীয় শ্রেণির এই কর্মচারির ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় রয়েছে অর্ধডজন অত্যাধুনিক বাড়ি ও প্লট। এ ছাড়া নামে-বেনামে রয়েছে শত শত কোটি টাকা। দেশে স্ত্রী ও নিজের নামে অন্তত পাঁচটি বাড়ি, আটটি ফ্ল্যাট, শতাধিক বিঘা জমি ছাড়াও আছে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য। সর্বাধুনিক মডেলের পাঁচটি গাড়ির মালিক তিনি। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে চাকরি থেকে আবজালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এমন সব ঘটনা ঘটছে, যাতে আমরা বিস্মিত হচ্ছি। ঘুষ ছাড়াই চাকরি মিলছে বাংলাদেশে। প্রথম শ্রেণির চাকুরি তো বটেই, নিচের দিকের অনেক চাকুরি এখন ঘুষ ছাড়া মিলছে! দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ‘ঘুষ ছাড়া’ চাকরি, খুশিতে কাঁদলেন অভিভাবকেরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৫ মার্চ, ২০১৮ তারিখে। সেখানে বলা হয় , “বগুড়ায় পুলিশ কনস্টেবল পদে পরীক্ষায় অংশ নেন ৪ হাজার ৩০০ জন। তাঁদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন ২০০ জন। অনেক অভিভাবকের দাবি, এবার ঘুষ ছাড়াই চাকরি হচ্ছে। ঘুষ ছাড়াই চাকরি হচ্ছে তাঁদের সন্তানদের, এই খুশিতে শতাধিক অভিভাবক গতকাল বুধবার দুপুরে পুলিশ সুপারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় অনেকে আনন্দে কেঁদে ফেলেন”।

এক দারোয়ানের কথা শুনেছিলাম, যার দুই মেয়ের প্রাইমারি স্কুলে চাকরি হয়ে গেছে। এক টাকাও ঘুষ দিতে হয়নি। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ যে কীভাবে বদলে গেছে সেটি বলতে গেলে লেখা শেষ হবে না। ডিজিটাল সুবিধা পেয়ে মানুষ কতটা সহজ জীবনে অভ্যস্ত হতে পারছে সেটি দৃশ্যমান। পুলিশ ৯৯৯ সার্ভিস চালু করেছে। ফোন করার সাথে সাথে পুলিশ হাজির হয়ে বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করছে। এটি আগে ভাবাই যেত না। এমন অনেক পরিবর্তন আমরা দেখছি।

এই পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত থাকুক। দুর্নীতি নির্মূল করতে পারলে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। ইতোমধ্যেই অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত রাষ্ট্রের তালিকায়ও নাম লেখাবে বাংলাদেশ, যদি দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা দূর করা যায়। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে দুদকের চলমান অভিযান আরও বেগবান করা হোক।

লেখকঃ প্রবন্ধকার ও গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :