ভোক্তা ঠকছে মোড়কে

প্রকাশ | ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩৫

কাজী রফিক

রাজধানীর শ্যামলীর একটি দোকান থেকে এক কেজি মিষ্টি কিনলেন হাসানুর রহমান। দাম আড়াইশ টাকা। তাকে মিষ্টির সঙ্গে যে বাক্সটি দেওয়া হয়েছে এর ওজন একটু বেশি মনে হওয়ায় সন্দেহ হলো। তিনি প্যাকেটটি বাদ দিয়ে শুধু মিষ্টি মাপালেন। দেখলেন এক কেজিতে প্রায় ১০০ গ্রাম কম। সে হিসেবে মিষ্টির বাক্সটির দাম পড়েছে ২৫ টাকা। বিষয়টি নিয়ে দোকানিদের সঙ্গে তার তর্ক হলো, তবে কোনো সমাধান এলো না।

এভাবে মোড়কে ঠকছেন অনেক ক্রেতা। বিক্রেতারা বিভিন্ন পণ্য দিতে গিয়ে যে প্যাকেট সরবরাহ করছেন সেটাও সেই পণ্যের দামেই বিক্রি করছেন। অথচ নিজেরা অর্ডার দিয়ে একটু বেশি ওজনের প্যাকেট বানিয়ে নিচ্ছেন। একটি প্যাকেটে যেখানে খরচ হচ্ছে ছয় থেকে সাত টাকা সেখানে তা বিক্রি করছেন ২০ থেকে ৩০ টাকায়।

ভোক্তা ঠকাতে বিক্রেতারা যত ফাঁদ তৈরি করেছেন, তার মধ্যে একটি এই মোড়কের অতিরিক্ত ওজন। মান নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থা বিএসটিআইএর মেট্রোলজি শাখা নানা সময় ওজনে কম দেওয়ায় ব্যবসায়ীদের সাজা দিলেও এই মোড়ক প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির কম। মাঝে কেবল ভেজালবিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত এক দুটি মিষ্টির দোকানে অভিযান চালিয়ে এই প্রতারণার প্রমাণ পেয়ে সাজা দিয়েছিল।

তবে এই ধরনের ব্যবস্থা যে ভোক্তার ঠকে যাওয়া রোধ করতে পারেনি, সেটার প্রমাণ মেলে বাজারে গেলেই। মিষ্টির পাশাপাশি ওজন হিসাবে ফল কিনতে গিয়েও ঠকছেন ক্রেতারা।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মোড়কের ওজন বাড়িয়ে দিয়ে যে প্রতারণা চলছে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো আইন বা বিধিমালা নেই। তবে আমাদের প্যাকেজ বিধিমালা যেটা আছে সেটা সংশোধন করা প্রয়োজন।’

রাজধানীর শ্যামলী ফুটওভার ব্রিজের নিচে ফল বেচেন বেশ কয়েকজন। এখানে ক্রেতাদের ফল দেওয়া হয় কাগজের ভারী প্যাকেটে। দুই কেজি আকারের একটি খালি প্যাকেট ওজন করে দেখা গেল ১১০ গ্রাম। ক্রেতারা জানালেন, এ ধরনের প্যাকেট তারা নিজেরা তৈরি করেন না, কিনে আনেন। প্রতি কেজি ৫০ টাকা।

মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউসিং কাঁচাবাজারে তিনটি ফল বিক্রির দোকান। এখানে কাগজের প্যাকেটে দেওয়া হয় ফল। স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা ফলের দামে প্যাকেট কিনছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ আল-আমিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘ফল কিনতে গিয়ে আমরা সব সময়ই ঝামেলায় পড়ি। যে প্যাকেটে দেয় সেই প্যাকেটের ওজনই তো একশ গ্রামের ওপরে।’

এই ক্রেতা বলেন, ‘এক কেজি আপেল প্যাকেটসহ মাপলে যা পাবেন, প্যাকেট ছাড়া মাপলে অন্তত একটা আপেল বেশি পাবেন। এখন বলেন, একটা কাগজের প্যাকেট আর একটা আপেলের দাম কি এক?’

একই চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা এবং মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফল দোকানগুলোতে। দুই কেজি আকারের একেকটি প্যাকেটের ওজন দেখা গেছে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত।

বাড়তি ওজনের মিষ্টির প্যাকেটের কথা প্রায় সবারই জানা। হাতেগোনা কিছু নামি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাড়তি ওজনের প্যাকেটে মিষ্টি বিক্রি করেন অনেক বিক্রেতা। একাধিকবার জরিমানা গুণলেও এর কোনো সমাধান আসেনি।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর ঢোল ক্যাম্পে দুটি দোকান রয়েছে, যেখান থেকে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয় এসব কাগজের প্যাকেট। সোহেল বক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মী বাদল ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা ওয়াডার অনুযায়ী মাল বানাই। যে যেমন সাইজ চায়, যেমন ওজনের চায়, আমরা তা দেই।’

বাদলের দেওয়া তথ্যমতে, ২৫০ গ্রাম আকারের মিষ্টির প্যাকেটের ওজন ২০ থেকে ২৫ গ্রাম, ৫০০ গ্রাম আকারের প্যাকেটের ওজন ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম, এক কেজি আকারের ওজন ১০০ গ্রাম এবং দুই কেজি আকারের প্যাকেটের ওজন ১৫০ থেকে ২০০ গ্রাম। ক্রেতাদের কাছে তারা এই প্যাকেট বিক্রি করেন প্রতিটি সর্বোচ্চ আট টাকায়।

একই তথ্য জানিয়েছেন শাহিদ বক্স স্টোরের সাজ্জাদ। তিনি বলেন, ‘ওজন নির্ভর করে কাস্টমারের ওপর। আর ওজন বেশি হলে দামও কিন্তু বাড়ে।’

ভুক্তভোগীরা জানান, প্রতিটি মিষ্টির প্যাকেটে ওজন এত  বেশি যে, প্যাকেটের কারণে তারা প্রতি কেজিতে দুই থেকে তিনটি করে মিষ্টি কম পাচ্ছেন।

নবিউল ইসলাম নামের এক ভুক্তভোগী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এক কেজিতে কয়টা মিষ্টি উঠতে পারে সে ধারণা আমাদের আছে। কিন্তু একেক জায়গায় একেক রকম দেখি। কোথাও কেজিতে ১৭-১৮টা ওঠে, কোথাও ১৪-১৫টা। একই মিষ্টি একই সাইজ, কম বেশি হবে কেন? প্রত্যেকটা দোকানের প্যাকেটের ওজন ১০০ গ্রামের বেশি।’

প্যাকেটের বাড়তি ওজন দেখা গেছে, ঢাকা মহানগর এলাকার বাইরেও। সাভার ও কেরানীগঞ্জ উপজেলার আঁটিবাজার কম দামের মিষ্টির জন্য পরিচিত। ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন এসব জায়গায়। সেই সঙ্গে ঠকছেনও। আঁটিবাজার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ মিষ্টির দোকানের প্যাকেট বেশ মোটা। ওজনের দিক থেকেও ভারী। আর ক্রেতাদের মিষ্টি দেওয়ার সময় প্যাকেটের ওজন বাদ না দিয়েই মিষ্টি ও মিষ্টিজাতদ্রব্য বিক্রি করা হচ্ছে।