ইটভাটায় শিশুশ্রমিকদের দাসজীবন

মাসুদ আলম, কুমিল্লা
 | প্রকাশিত : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩০

‘আমরা গরিব বলে মানুষ হিসেবে আমাদের কোনো মূল্য নেই।’

কথাগুলো মাত্র ১২ বছরের শিশু বাবলুর। কাজ করছে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার হক ব্রিকফিল্ডে। অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাত মাসের চুক্তিতে নোয়াখালী থেকে শ্রমিক হিসেবে এসেছে।

বাবলুর অভিযোগ, ইট তৈরির এই মৌসুমে বেশি মজুরির আশ্বাসে তাকে ইটভাটায় নিয়ে এসেছেন সর্দার। সাত মাসের চুক্তিতে যে মজুরি দেওয়ার কথা থাকে তা পাওয়া কষ্টসাধ্য।

স্বল্প মজুরিতে কাজ করলেও চুক্তির বাইরে এক দিনও ছুটি পাওয়া যায় না। সাত মাসের এক দিন বাকি থাকলেও সর্দার ও মালিক এক টাকাও দেবেন না বলে জানিয়েছেন। অসুস্থ বা কোনো কারণে এক দিনের জন্য বাড়িতে যেতে হলেও একজনকে মাধ্যম দিয়ে যেতে হয়। থাকা-খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা রাখেন না কর্তৃপক্ষ। ভাটাতেই ঘুমাতে হয়।

এদিকে আইনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তাই ইটভাটায় অপরিচিত কোনো ব্যক্তির প্রবেশ দেখলেই কর্তৃপক্ষ বাবলুসহ কর্মরত শিশুশ্রমিকদের লুকিয়ে ফেলেন।

সরেজমিন জানা গেছে, কুমিল্লার ১৭টি উপজেলায় বৈধ ও অবৈধ চার শতাধিক ইটভাটায় একই অবস্থা। ভাটাশ্রমিকদের বেশির ভাগই ৯ থেকে ১৫ বছরের শিশু। এসব শিশুশ্রমিকের বাড়ি আশপাশের জেলাসহ উত্তরাঞ্চলে। তাদের বিভিন্ন সিন্ডিকেট ও সর্দারের মাধ্যমে চুক্তিতে এনে স্বল্প মজুরিতে কাজ করানো হচ্ছে। আধুনিক যুগের দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা তাদের শৈশব।

চৌদ্দগ্রামের কিং অ্যান্ড কোম্পানি ইটভাটায় কয়লাবাহী ট্রাক উল্টে ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় জেলার অন্য ভাটাগুলোর মালিকদের মাঝে আতঙ্ক থাকলেও অন্যায়-অনিয়ম থেকে বিন্দুমাত্র সরেননি তারা।

বিভিন্ন ইটভাটার শ্রমিকরা জানান, অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সর্দারের মাধ্যমে চুক্তিতে ইট বানানোর কাজ করতে হয় তাদের। পুরো সাত মাসের জন্য সর্দারই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি করেন। কাজ শুরুর আগে তিনি শ্রমিককে কিছু টাকা অগ্রিম (দাদন) দিয়ে রাখেন। প্রতিদিন ১৬-১৭ ঘণ্টা কাজ করে ইট বানানোর কারিগররা ছয় মাসের জন্য এক লাখ টাকা, জোগালি ৪০ হাজার টাকা, আগাটক ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, গোড়ারটক ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা এবং মাটি বহনকারী ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পান। চুক্তির বাইরে সাত দিনের খোরাকি জনপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা।

শ্রমিকরা আরও জানান, ফজরের আজানের পরপরই শুরু হয়ে দুই শিফটে কাজ করতে হয় তাদের। দুপুরে সামান্য বিরতি দিয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত কাজ চলে। ভাগ করে কয়েকজন দিনে কয়েকঘণ্টা বিশ্রামের সুযোগ পান। বিনিময়ে তাদের কাজ চলে সারারাত। আশানুরূপ কাজ বুঝে না পেলে চলে অমানুষিক নির্যাতন। শিশু শ্রমিকদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগই বেশি।

ইটভাটার পাশেই টিনের ঘর তুলে এক রুমে ১৫ থেকে ১৮ জন শ্রমিককে থাকতে হয়। সেখানে নিজেরা তিনবেলা রান্না করে খাবারের ব্যবস্থা করেন।

ইটভাটাগুলোতে দেখা গেছে, কেউ মাটি কাটছেন, কেউ সেই মাটি এনে জড়ো করছেন। আবার কেউ মাটি কাটের ছাঁচে ভরে ইটের আকারে সাজিয়ে যাচ্ছেন। রোদে পুড়ে সেই ইট শক্ত হলে কেউ কেউ তা ভ্যানে করে একস্থানে জড়ো করছেন। তারপর সেখান থেকে কয়েকজন কয়লার ভাটায় ছেড়ে ইট পোড়াচ্ছেন। সবশেষে ইটগুলো জড়ো করা হচ্ছে বিক্রির জন্য।

হক ব্রিকফিল্ডের শিশুশ্রমিক বাবলু আরও জানিয়েছে, ছোট-বড় তারা প্রায় ৩০ জন নোয়াখালী থেকে এসেছেন। ৪০ হাজার টাকায় ছয়মাসের চুক্তিতে ইট বানানোর কাজে যোগ দিয়েছে সে। স্কুল ভালো না লাগায় অভাবের সংসারে সহায়তা করতে তিনমাস আগে তার এই পেশায় আসা বলেও জানায় সে।

বাবলু জানায়, সে একাই প্রতিদিন ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০টি কাঁচাইট তৈরি করে। কোনোদিন একটু কম হলে সর্দার ও মালিক গালাগালি করেন।

সর্দার হেলাল মেম্বারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি কুমিল্লার বিভিন্ন ইটভাটায় শ্রমিক সরবরাহ করেন। হক ইটভাটায় তার ৫০ জন শ্রমিক রয়েছে। তার মধ্যে বেশিরভাগ ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশু।

তিনি বলেন, ব্রিক ফিল্ডের মালিকদের চাহিদা অনুসারে চুক্তিতে শ্রমিক দেওয়া হয়। তবে তারা ওই শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার কোনো দায়িত্ব নেন না। শ্রমিকরা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও কাজের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেন না।

হক ব্রিকফিল্ডের পরিচালক আল ইমরানের দাবি, ‘জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন-কানুন অনুসরণ করেই আমরা ইটভাটা পরিচালনা করছি।’ শ্রম আইন ও শিশুশ্রমের বিষয়ে অবশ্য ওই পরিচালক কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীর বলেন, ‘চৌদ্দগ্রামের ইটভাটায় কয়লাবাহী ট্রাক উল্টে ঘুমন্ত ১৩ শ্রমিক নিহতের ঘটনার পর অন্য ভাটাগুলো আমাদের নজরে রয়েছে। ইটভাটাগুলোতে পরিবেশ, শ্রম ও শিশুশ্রম আইন না মানার বিচারে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছেন। অভিযোগ পেলেই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালাচ্ছি। গত কয়েকদিনে জেলা প্রশাসন একাধিক ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :