ফারমার্সের লুটপাটের কী হবে

প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:৩২

রহমান আজিজ

ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িত ফারমার্স ব্যাংকের নাম পাল্টে ফেলা হলেও পুরোনো কেলেঙ্কারির দায় এখনো টানছে প্রতিষ্ঠানটি। কারণ ঋণের নামে বের করে নেওয়া টাকা ফেরত আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা, এর জন্য শাস্তিও হয়নি কারও।

ব্যাংকটির সরিয়ে দেওয়া সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও এখন পর্যন্ত কাক্সিক্ষত কোনো সুফল আসেনি। আবার কারও কারও নামে আইনি কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি। যদিও এই কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আক্ষেপ করে বলেছিলেন, কর্তাব্যক্তিরাই ব্যাংকটিকে শেষ করে দিয়েছেন।

গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী পদে পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের প্রতিষ্ঠানটির জন্য তৈরি করা হয়েছে নতুন নানা সুযোগ-সুবিধা। আর পুরোনো নামের দুর্নাম যেন বইতে না হয়, সে জন্য নতুন করে নাম দেওয়া হয়েছে ‘পদ্মা ব্যাংক’।

কিন্তু পুরোনো কেলেঙ্কারির কী হবে এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যাংকটির নতুন কর্মকর্তারা বলেন, সেটাও সরকারের বিষয়। তবে নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ এবং পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যেই গ্রাহকের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে।

এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় মোট পাঁচটি মামলা হলেও তদন্তই শেষ হয়নি চারটির। দুদকের উপপরিচালক শামসুল আলম ঢাকা টাইমসকে জানান, ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে একটি তদন্ত শেষ হয়েছে, বাকিগুলোর তদন্ত চলছে।

এক দশক ধরেই ব্যাংকে খেলাপি ঋণ আর ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়টি তুমুল আলোচিত। প্রায় এক লাখ কোটি টাকা খেলাপি এবং আরও ৪৫ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করা ঋণ কীভাবে উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে কৌশল বের করতে গলদঘর্ম নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, এখন থেকে এক টাকাও খেলাপি বাড়া চলবে না। আর প্রতিটি ব্যাংকেই বিশেষ নিরীক্ষা হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফারমার্স ব্যাংকে মতিঝিল ও গুলশান শাখায় বড় অঙ্কের জালিয়াতি হয়েছে। রে মধ্যে মতিঝিল শাখার ঋণ প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি এবং গুলশান শাখার ঋণ এক হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

এসব অনিয়ম হয়েছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর সময়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ফারমার্স ব্যাংকের গ্রাহকদের দেওয়া ঋণের ভাগ নিয়েছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে দুজনের নৈতিক স্খলন ঘটেছে এবং তাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।’

তাদের মধ্যে চিশতীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি গ্রেপ্তারও হয়েছেন। তার স্বজনদেরও বিদেশযাত্রায় আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। তবে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি এখনো।

অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় অনুসন্ধানে গতি আনতে গত জুলাই মাসে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিমের পুনর্গঠন করা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক সামসুল আলমের নেতৃত্বে দুদকের সহকারী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম, উপসহকারী পরিচালক জয়নুল আবেদীন ও সাহিদুর রহমান এ বিষয়ে কাজ করছেন।

জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকটির টাকা আত্মসাতের পর তারা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রয়েছেন বলে দুদকের সন্দেহের প্রেক্ষিতে গত মার্চে ব্যাংকের ১৭ জন কর্মকর্তা ও গ্রাহকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

তাদের মধ্যে কর্মকর্তা রয়েছেন এ কে এম শামিম (এমডি অ্যান্ড সিইও), আব্দুল মোতালেব পাটোয়ারী (ডিএমডি), গাজী সালাউদ্দিন (এসইভিপি), জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার (ইভিপি), জিয়া উদ্দিন আহমেদ (এসভিপি), লুৎফুল হক (ভিপি), মনিরুল হক (ভিপি), তাফাজ্জল হোসেন (এফভিপি), শামসুল হাসান ভুঁইয়া (এভিপি), মাহবুব আহমেদ (এইও) ও জাকির হোসেন (ইও)।

গ্রাহকেরা হলেন মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী), তার স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, পূত্রবধূ ফারহানা আহমেদ, মেয়ে রিমি চিশতী ও মাজেদুল হক চিশতী।

মাহবুবুল হক চিশতী ফারমার্স ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ঋণ বিতরণে একাধিপত্যের অভিযোগে তাকে পদ থেকে অব্যাহতিও দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১৬০ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং মামলা করে দুদক। ওই মামলায় বাবুল চিশতী ও তার ছেলে বর্তমানে কারাগারে।

গত ৩০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে জারি করা ‘দি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড’ নামকরণ করা হয়।

এই ব্যাংকের ৬০ শতাংশের বেশি শেয়ারের মালিক এখন রাষ্ট্রায়াত্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী এবং ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশান অব বাংলাদেশ-আইসিবি।

ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের কারণে ২০১৮ সালের প্রথম দিকে সরকারের হস্তক্ষেপে ডুবতে থাকা ব্যাংকটির বেশির ভাগ শেয়ার সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী এবং আইসিবি কিনে নেয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরু ঢাকা টাইমসকে জানান, ‘আমি যখন এমডির দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন ব্যাংকে মাত্র ৩০ হাজার টাকা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ১৮০০ কোটি টাকা গ্রাহকের আমানত পরিশোধ করা হয়েছে। অর্থাৎ, গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। এটি ধরে রাখতে ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।’

টাকা উদ্ধারের অগ্রগতি কত দূর জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অর্থ আদায়ে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের সংস্থা বেশ কিছু মামলা করেছে। তদন্তও চালিয়ে যাচ্ছে। অগ্রগতি হয়েছে কি হয়নি, সেটি সরকারের বিষয়।’

নাম পাল্টে কী লাভ হবে এমন প্রশ্নে এহসান খসরু বলেন, ‘ব্যাংকের গ্রাহক এবং দেশের মানুষের কাছে ফারমার্স ব্যাংক একটি পচা বিষয়। এ জন্য নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আমানতও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন করে আমানত আসছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকের নাম, চেকবইÑ সব ক্ষেত্রে পদ্মা ব্যাংক নামে কার্যক্রম শুরু করেছে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মামলা করে টাকা আদায় করা খুবই সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর বিষয়। জনগণের এই টাকা দ্রুত উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।’