নাব্যতার সংকট-ডুবোচর

পদ্মায় আটকা পড়েছে অর্ধশত পণ্যবাহী নৌযান

প্রকাশ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:৪৮

ফরিদপুর প্রতিবেদক

পদ্মায় নাব্যতা-সংকটের পাশাপাশি নদীর মাঝে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য ডুবোচর। এ কারণে গত এক মাসে আটকা পড়েছে ফরিদপুর নৌবন্দরমুখী পণ্যবাহী প্রায় অর্ধশত জাহাজ, কার্গো ও ট্রলার।

বন্দরের পন্টুুন থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে হাজীগঞ্জে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে নদীতে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হলেও কবে নাগাদ নৌপথটির নতুন চ্যানেল সৃষ্টি হবে, তা সঠিকভাবে বলতে পারছেন না কেউ।

২০১৭ সালে প্রায় শত বছরের প্রাচীন ফরিদপুরের সিঅ্যান্ডবি ঘাটকে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দর ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে নৌপথে এই বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা হয়। সিলেট থেকে কয়লা ও বালু, ভারতের গরু ও চাল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া ও মিরকাদিম থেকে চাল এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে সিমেন্ট আনা ছাড়াও ফরিদপুরের সোনালি আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়। সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্তমানে পদ্মার বুকে নাব্যতা না থাকায় এবং নদীজুড়ে অসংখ্য ডুবোচর তৈরি হওয়ায় নৌবন্দরটি প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। দেশের বিভিন্ন বন্দর থেকে বোরো মৌসুমের সার, গম, সিমেন্ট, কয়লা, বালুসহ নানা পণ্য নিয়ে সুদীর্ঘ নৌপথ পাড়ি দিয়ে আসার পর বন্দরে ভিড়তে অপেক্ষা করছে এসব নৌযান। কিন্তু পদ্মায় পর্যাপ্ত নাব্যতা না থাকায় নোঙর করতে না পেরে বন্দরের অদূরে গদাধরডাঙ্গীসহ চরভদ্রাসনের হাজীগঞ্জ ও জাকেরের সুরা এলাকায় পণ্য নিয়ে অবস্থান করছে সেগুলো।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৫০ টন সার নিয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি জাকেরের সুরায় এসে আটকা পড়েছে পণ্যবাহী কার্গো এমভি মুগনি-১। নৌযানটির চালক সাহাবউদ্দিন জানান, বন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে যে পরিমাণ পানি থাকা প্রয়োজন, সেই পানি এখন নেই বলে আর এগোতে পারছেন না। তিনি বলেন, অন্ততপক্ষে ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেখানে কোথাও বা দুই-তিন হাত পানি রয়েছে। এভাবে অরক্ষিত স্থানে পণ্যসহ কার্গো ভেড়ানোর কারণে তারা স্টাফসহ নিরাপত্তাহীনতায়ও রয়েছেন। এখন পণ্য খালাসে নানা ধরনের হয়রানি ছাড়াও পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে বলেও আশঙ্কা তার।

আরেকটি জাহাজের ইঞ্জিনম্যান রবিউল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সাড়ে ১০ হাজার বস্তা সার নিয়ে এসে সাত দিন ধরে হাজীগঞ্জে আটকে আছি। প্রতিদিনই মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। আমাদের যেসব দিন নষ্ট হচ্ছে, সে জন্য মালিক অতিরিক্ত টাকা দেবেন না। এখন তাই হাজীগঞ্জেই মাল খালাসের চিন্তা-ভাবনা করছি।’

ফরিদপুর নৌবন্দরে কর্মরত খায়রুজ্জামান বলেন, বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ও কার্গো আসতে না পারায় ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এখানকার প্রায় আট হাজার কুলিশ্রমিকও বেকার দিন কাটাচ্ছেন। দুটি পন্টুন তৈরি শুরু হলেও এখনো সম্পন্ন না হওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ছে।

নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে আরও ড্রেজিং মেশিন বসানো উচিত বলেও মনে করেন তিনি।

ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়িক পণ্য আনা-নেওয়া করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নৌবন্দর। বছরের প্রায় পাঁচ মাস নদীতে পানি কম থাকায় বন্দরে পণ্য খালাসে জটিলতার সৃষ্টি হয়। পদ্মার বুকে অসংখ্য ডুবোচর তৈরি হওয়ায় এক মাস ধরে বন্দরমুখী পণ্যবাহী প্রায় অর্ধশত জাহাজ ও কার্গো বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়েছে।

পদ্মার বুকে পানি না থাকলে ফরিদপুরের কুমার নদের উৎসমুখ খননে পদ্মার মদনখালী থেকে ৩০০ কোটি টাকার খনন প্রকল্পটিও কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

ফরিদপুরের নৌবন্দরের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান রিয়াজ আহমেদ শান্ত ও করপোরেশনের প্রতিনিধি নাফিজুল ইসলাম তাপস বলেন, বন্দর হওয়ার পর আগের চেয়ে তিন গুণ বেশি দরে নদীর ঘাট ইজারা নিচ্ছি। কিন্তু পানির স্বল্পতায় বন্দরে নৌযান ভিড়তে না পারলে আমাদের লাভ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো পথে বসতে হবে।’

ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক উম্মে সালমা তানজিয়া জানান, ‘বন্দরটি সচল রাখতে নৌ মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে জরিপ করেছে। আশা করছি, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হবে।’

বন্দরের পোর্ট অফিসার শেখ মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘নাব্যতার সংকট রয়েছে এটা ঠিক। তবে একেবারে যে নৌযান আসছে না, তা নয়। ছোট কার্গো ও জাহাজ ভিড়ছে। নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে একটি ড্রেজিং মেশিন কাজ করছে। তবে কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না।’