গুটি বসন্তের শেষ মহামারির ভয়ঙ্কর গল্প

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:১৬

পৃথিবীতে শেষবার স্মল পক্স বা গুটি বসন্তের বড় মাপের মহামারি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে ভারতে। হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেই মহামারিতে। সেই মহামারিতে উত্তর প্রদেশ এবং বিহারে এক লাখ দশ হাজার মানুষ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল বলে সেসময় এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল বিবিসি।

আক্রান্ত রোগীদের একেবারে বিচ্ছিন্ন করে সেই মহামারি সামাল দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের গুটি বসন্তের সেই মহামারি ঠেকাতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন ড মহেন্দ্র দত্ত এবং ড ল্যারি ব্রিলিয়ান্স। এই দুই চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে বিবিসি। সেখানে উঠে এসেছে সেই মহামারির ভয়ঙ্কর গল্প।

১৯৭৪ সালে ভারতের সেই মহামারি ঠেকাতে নজিরবিহীন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এক কোটি গুটি বসন্তের টিকা দেওয়া হয়েছিল। ১০ লাখ সুঁই ব্যবহার করা হয়েছিল। ছয় লক্ষ গ্রামের ১২ কোটি বাড়িতে গিয়ে গিয়ে গুটি বসন্তের রোগীর সন্ধান করা হয়েছিল। এ কাজে লাগানো হয়েছিল ১ লক্ষ ৩৫ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী।

মারাত্মকভাবে আক্রান্ত বিহার রাজ্যে সেই উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন ড. মহেন্দ্র দত্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাকে বিহারে পাঠানো হয়েছিল। যে বছর খানেক ধরে গুটি বসন্তের প্রকোপ চলেছিলো, পুরো সময়টা তিনি সেখানে ছিলেন। সেই স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘দুটো দল কাজ করছিল। একটি দলের কাজ ছিল নতুন রোগী খুঁজে বের করা, অন্য দলটির কাজ রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখা। আমার দায়িত্ব ছিল এই দুই দলের তদারকি করা। কোথাও অসুবিধা দেখা দিলে দ্রুত সেটা দূর করা।’

প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল গুটি বসন্ত। ফ্লু ভাইরাসে একজনের কাছ থেকে আরেকজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল গুটি বসন্তের জীবাণু। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি কারণ ছিল ঘন বসতি। অনেক বাড়িতে ছিল একটি মাত্র ঘর।

ড. এডওয়ার্ড জেনার নামে একজন ব্রিটিশ ডাক্তার ১৭৯০ সালের দিকে গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। ৫০ এবং ৬০ এর দশক জুড়ে ভারতে এই টিকার ব্যাপক ব্যবহার হয়েছিল। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু এলাকায় এই রোগ থেকেই গিয়েছিল।

মহেন্দ্র দত্ত জানান, ১৯৭৩ সালে নেওয়া গুটি বসন্ত নির্মূল করার ব্যাপক এক কর্মসূচির ফলে উত্তর প্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিম বাংলায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়েছিল। গণহারে টিকা দেওয়ার বদলে আমরা রোগী খুঁজে বের করে রোগের বিস্তার ঠেকানোর কৌশল নিয়েছিলাম, যেখানে চীন গণহারে টিকা কর্মসূচি নিয়েছিল।’

ড ল্যারি ব্রিলিয়ান্স ছিলেন সেসময় ভারতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সেই কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা। তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে ভারতে যত মানুষ গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল, অতীতে কোনো একটি দেশে একসঙ্গে এত রোগী দেখা যায়নি।

১৯৭৪ সালের সেই মহামারি দেখা দেওয়ার আগে থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত নির্মূলের কর্মসূচি নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও কেন ভারতে সেই মহামারি দেখা দেয়?

ব্রিলিয়ান্স বলেন, ‘ভারতের বিশাল জনসংখ্যা এবং আর্ত-সামাজিক বাস্তবতার কারণে সেটি হয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে প্রতি বছর ৫০ কোটি লোকের সবাইকে টিকা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। এই গ্রামে দুইশ লোক, ওই গ্রামে পাঁচশ লোক বাদ পড়ে যেত। ফলে ভারতে কিছু কিছু এলাকায় ঝুঁকি থেকেই গিয়েছিল।’

তিনি বলেন, সেসময় ভারতের অনেক জায়গায় স্বাস্থ্য সেবা ছিল দুর্বল। পুষ্টির ভীষণ অভাব ছিল। ফলে এমনিতেই ডায়রিয়া বা নিউমোনিয়ার মত রোগে ভুগে পাঁচ বছর বয়সের আগেই অর্ধেক শিশু মারা যেত। স্বাভাবিকভাবেই ওই ধরনের রোগ ঠেকানো সেখানে অগ্রাধিকার পেত। ফলে, গুটি বসন্তের বিষয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব হত না।

টিকা দেওয়া নিয়ে অনেক প্রতিরোধের কথা জানিয়ে মহেন্দ্র দত্ত বলেন, জীবন বাঁচাতে তারা অনেক সময় কঠোর সব পন্থা নিতেন। বিশেষ করে উপজাতীয় এলাকাগুলোতে যখন মানুষজন টিকা নিতে অস্বীকার করত, আমরা অনেক সময় কাঁটাতার দিয়ে ছয় সপ্তাহের জন্য পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলতাম। তারপর একেক করে সবাইকে টিকা দেওয়া হত।’

১৯৭৪ সালে মধ্যপ্রদেশ রাজ্য থেকে যখন গুটি বসন্ত ছড়ানোর খবর আসতে থাকল, তখন ল্যারি ব্রিলিয়ান্সসহ আরো কয়েকজন ডাক্তারকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। ব্রিলিয়ান্স বলেন, ‘আমরা গর্ব করতে শুরু করেছিলাম যে মধ্য প্রদেশের মতো এত বড় রাজ্যকে আমরা গুটি বসন্ত মুক্ত করতে পেরেছি। কিন্তু হঠাৎ করে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গুটি বসন্তে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসতে থাকে ...বুঝতে পারছিলাম না যে কী হচ্ছে। পরে অনুসন্ধান করে দেখা গেল এই রাজ্য থেকে যেসব যুবক কাজের খোঁজে বিহারের টাটানগর গিয়েছিল, তারা ফিরে আসার পর নতুন করে রোগ ছড়িয়েছে।’

ব্রিলিয়ান্স জানান, তিনি এবং তার কয়েকজন সহকর্মী তখন টাটানগর গিয়ে যা দেখলেন, তা তিনি সারা জীবনে ভুলতে পারবেন না। ‘ট্রেন স্টেশনে নেমে দেখলাম প্লাটফর্মে এবং আশপাশে কাঠের স্তূপের মত মৃত শিশুদের স্তূপ। টিকেট কাটছে এমন একজনকে দেখলাম তার হাতে গুটি বসন্তের চাকা। আমি ভাবলাম এই লোক এখন ট্রেনে চেপে হয়ত হাজার মাইল দুরে তার গ্রামে ফিরে যাবে এবং সেখানে গিয়ে এই জীবাণু ছড়াবে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম এই টাটানগর থেকেই গুটি বসন্তের জীবাণু রপ্তানি হচ্ছে।’

টাটানগর এবং পুরো বিহার রাজ্য থেকে ছয় মাসের মধ্যে গুটি বসন্ত নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৫ এর মে মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখে ভারতের সর্বশেষ গুটি বসন্তের রোগী পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য ঘোষণা করে পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত নির্মূল হয়েছে। বিশ্বে সেই প্রথম কোনো রোগ এভাবে নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল।

মহেন্দ্র দত্ত মনে করেন- ‘অন্য কোনো রোগ যদি এভাবে নির্মূল করতে হয়, তাহলে ভারতে গুটি বসন্ত নির্মূলের সেই অভিজ্ঞতা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। প্রথম কথা আপনাকে একটি কার্যকরী কৌশল নিতে হবে এবং তারপর সেই কৌশল বাস্তবায়নে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী নিয়োগ করতে হবে।’

ঢাকা টাইমস/০৭ফেব্রুয়ারি/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :