প্রস্তুত যশোরের চাষিরা
৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট
দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্তের প্রথম দিন, ভালোবাসা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি। তিনটি দিবসের সঙ্গেই সম্পর্ক ফুলের। দিবসগুলো পড়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। এ জন্য সারা বছর যে ফুল বিক্রি হয়, তার বেশির ভাগ বিক্রি হয় এই ফেব্রুয়ারিতে। আর দেশের ফুলের চাহিদার প্রায় ৭০ ভাগ জোগান দেন যশোরের চাষিরা।
যশোরের ঝিকরগাছাসহ বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফুল দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। এবার তিনটি দিবসকে কেন্দ্র করে এই ফেব্রুয়ারিতে ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট করেছেন এখানকার চাষিরা। সেই লক্ষ্য পূরণে এখন তারা ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুল পরিচর্যায়।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, এবার যশোরে পাইকারি পর্যায়ে ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যশোরে প্রায় ছয় হাজার চাষি দেড় হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফুল চাষ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্লাডিওলাস। ৪০ শতাংশ চাষি এই ফুল চাষ করেন।
এরপরই ২০ শতাংশ চাষ হয় রজনীগন্ধা। গোলাপ চাষ হয় ১৫ শতাংশ। এখানকার উৎপাদিত জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল দ্বারা সারা দেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছেন চাষিরা।
সামনে বড় বাজার ধরতে যশোরের চাষিরা এখন ফুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত। তারা জমিতে সেচ প্রদান, গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরানো, সার-কীটনাশক, আগাছা পরিষ্কার করাসহ আনুষঙ্গিক পরিচর্যা করছেন।পানিসারা মাঠপাড়া এলাকার ফুলচাষি তবিবর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা বংশপরম্পরায় এই ফুল চাষে এসেছি। আমার বাবা ফুল চাষ করতেন। এখন আমিও ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এবার চার বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছি। এর মধ্যে রজনীগন্ধা দুই বিঘা, গোলাপ ও জারবেরা এক বিঘা করে। সামনে ফুলের বড় বাজার রয়েছে, সেটা ধরতে আমরা অপেক্ষায় আছি।’
গদখালীতে কথা হয় তরুণ ফুলচাষি আশরাফুল ইসলাম চান্দুর সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘চার বিঘায় গোলাপ, দুই বিঘায় জারবেরা এবং এক বিঘায় গ্লাডিওলাস ও রডস্টিক চাষ করেছি। আমরা গোলাপের কুঁড়িতে ক্যাপ পরিয়ে রাখি, যাতে ফুল একটু দেরি করে ফোটে। বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস আর ২১ ফেব্রুয়ারিতে যাতে ফুল বাজারে দেওয়া যায় সেই চেষ্টা করছি।’
আশরাফুল বলেন, ‘প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় চার টাকার মতো। সাত-আট টাকা বিক্রি করা গেলে ভালো মুনাফা হবে বলে আশা করছি।’ তিনি জানান, ফুল চাষের ওপর তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এতে তিনি সফল হচ্ছেন বলে জানান। নাভারণ এলাকার ফুলচাষি নজরুল আলম জানান, তিনি ফুলের ব্যবসার পাশাপাশি চাষও করেন। তার চাষের মধ্যে জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রজনীগন্ধাসহ বেশ কয়েক ধরনের ফুল রয়েছে। তিনি জানান, তার জারবেরা ফুলে মাকল পোকা হানা দিয়েছে। সেই সঙ্গে আছে সাদা মাছির উৎপাত। কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শমতো কীটনাশক দিয়ে পোকামাকড় বিস্তার রোধ করার চেষ্টা করছেন বলে জানান এই চাষি।
নজরুল বলেন, ‘গত দু-তিন মাস ব্যবসা কিছুটা খারাপ গেছে। সময়মতো সামনের দিবসগুলোতে বাজার ধরতে পারলে তিন-চার লাখ টাকার মতো ফুল বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি।’ বাংলাদেশ ফ্লাওয়াল সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলাসহ এই জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে গদখালীতে মাত্র ৩০ শতক জমিতে ফুলের চাষ শুরু হয়। এখন চাষ হচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এই ফুল এখন যাচ্ছে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াতেও।’
আব্দুর রহিম বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবিকা এই চাষ বা ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুল চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ছয় হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। সামনের দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে প্রায় ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সারা বছর টুকটাক ফুল বিক্রি হলেও মূলত ফেব্রুয়ারি মাসের তিনটি উৎসবকে সামনে রেখেই জোরেশোরে এখানকার চাষিরা ফুল চাষ করে থাকেন।
কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি প্লাস্টিক ফুল আমদানি বা তৈরি করায় ব্যবসাটা কমে যায়। এই প্লাস্টিক ফুল বাজারজাতকরণ বন্ধ হলে ফুলের চাষ আরও বাড়ত। এ ছাড়া ঢাকায় স্থায়ী ফুলের বাজার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে ফুলের চাষ ও ব্যবসার প্রসার ঘটবে।’