মালেকা বেগমের ‘জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়’

রানা আহমেদ, সিরাজগঞ্জ
 | প্রকাশিত : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:২৩

ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া করে অনেক বড় হবেন। প্রথম ইচ্ছাটি পূরণ হয়নি, তবে দ্বিতীয়টি হয়েছে। তিনি অনেক বড় হয়েছেন, তবে লেখাপড়াটা করতে পারেননি ইচ্ছামতো। আর নিজের জীবনে যা হয়নি, সেটি অন্যের জীবনে যেন না হয় চেষ্টা করে যাচ্ছেন আপ্রাণ।

তার নাম মালেকা বেগম। বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার বড়হর ইউনিয়নের ডেফলবাড়ী গ্রামে। তিন দশক ধরে ছাত্রী পড়াচ্ছেন। কিন্তু বিনিময়ে একটি পয়সাও নেননি কারও কাছে।

মালেকার ছাত্রীরা সবাই গ্রামের শিশু আর গৃহবধূরা। এখানে এসে অক্ষরজ্ঞান নিয়ে শিশুরা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একেকটি শিশু বড় হয়, প্রাথমিক ছাড়িয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে যায়, যায় কলেজে, আর আনন্দে আত্মহারা হন মালেকা। অন্য রকম এক তৃপ্তি হয় তার।

না মালেকা কোনো ধনকুবের নন, অর্থবিত্তের সঙ্গে তার সখ্য হয়নি কখনো। কিন্তু শিক্ষা বিতরণের ইচ্ছার সঙ্গে অর্থের কোনো সম্পর্ক নেই-এটাই তিনি প্রমাণ করে চলেছেন।

এখানে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নেই। তিন দশক ধরে ছাত্রী পড়ালেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি নাম দেওয়া হয় আট বছর আগে; ‘ডেফলবাড়ী জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়’।

প্রতিদিন রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে ডেফলবাড়ি গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার শিশুরা বই খাতা নিয়ে দলবেঁধে চলে আসেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শিশু ও গৃহবধূরা বাড়ির উঠানে চট পেতে বসে পড়াশোনা করছেন। তাদের সব কিছু দেখিয়ে দিচ্ছেন মালেকা বেগম। বাংলা, ইংরেজি ও গণিত, কোনো কিছুই বাদ যাচ্ছে না।

মালেকা নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি বেশিদূর। পঞ্চম শ্রেণির পরই থামিয়ে দিতে হয়েছে তার স্কুলে যাওয়া। আর সেই আক্ষেপ তিনি ভুলছেন যতটুকু জেনেছেন, ততটুকু জ্ঞান মানুষের মধ্যে বিতরণ করে।

এই গৃহিণীর শুরুটা ছিল কোরআন শিক্ষার মধ্য দিয়ে। বিয়ে হয়ে আসার পর দেখতে পান গ্রামের বউরা ধর্মগ্রন্থ পড়তে পারেন না। নেই বাংলা, ইংরেজি অক্ষরজ্ঞান। মনস্থির করেন, প্রাথমিকভাবে শিশু ও বউদের কোরআন শেখাবেন। কয়েকটি মাদুর ও চটের ব্যবস্থাও করেন। নিজ বাড়ির উঠানেই শুরু করেন শিক্ষা কার্যক্রম।

ঘরের ব্যবস্থা করতে পারেননি, তাই খোলা আকাশের নিচেই চলছিল তার স্কুল। ২০১১ সালে ছেলে আবুল হোসেনের উদ্যোগে ‘ডেফলবাড়ী জ্ঞানের আলো শিক্ষালয়’ নামকরণ হয়।

গত আট বছরে এই শিক্ষালয় থেকে দুই শতাধিক শিশু এখানে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে।

মালেকা বেগম জানান, প্রায় ৩৬ বছর আগে তার বিয়ে হয় ওই গ্রামের আব্দুল কাদেরের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি খেয়াল করেন, ফুলজোড় নদীতীরবর্তী ভাঙন-কবলিত ডেফলবাড়ি এলাকায় শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ঠিক করেন, তিনি শেখাবেন।

মালেকা বেগমের ছেলে আবুল হোসেন বলেন, ‘অভাবের সংসারেও আমার মা শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে কোনো টাকাপয়সা নেননি। গ্রামের নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে চেয়েছেন। মায়ের এ কাজের জন্য ছেলে হিসেবে আমি গর্বিত।’

এই শিক্ষালয়ের শিক্ষার্থী গৃহবধূ সবুরা বেগম বলেন, ‘আমি মালেকা বেগমের কাছে অংক শিখেছি। এখন নিজেই পরিবারের সব খরচের হিসাব রাখতে পারি।’

মালেকা বেগমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসন। স্থানীয় ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘মালেকা বেগম যে কাজটা করেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। আমরা সবাই তাকে খুব শ্রদ্ধা করি।’

উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামানও জানেন মালেকার এই অবিরাম চেষ্টার খবর। তিনি বলেন, ‘তার বিনা পয়সায় এই শিক্ষালয়টি এলাকায় বেশ পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে বহু শিশু ও গৃহবধূদের মধ্যে বিনা পয়সায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছেন। তিনি হয়ে উঠেছেন এক আদর্শ শিক্ষিকা।’

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :