একদিকে বদির ‘ইয়াবা সাম্রাজ্য’ অন্যদিকে দান

প্রকাশ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৩:৪৭ | আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৬:৫৫

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
টেকনাফ উপজেলার মানুষের মাঝে বিনামূল্যে চাল বিতরণ করছেন আবদুর রহমান বদি

ইয়াবা কারবারে বারবার নাম আসা কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক দান খয়রাত করে থাকেন।

গত কয়েক বছর ধরে আলোচিত এই নেতা বছরে কেবল ১৯ কোটি টাকার মতো খরচ করেন চাল বিতরণে। মাসে টেকনাফে ৫৬ হাজার দরিদ্র মানুষকে বিনামূল্যে চাল বিতরণ করেন তিনি।

এর বাইরে চিনি, দুধ, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডাল এবং ছোলাও বিতরণ করেন রমজান মাসে। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বিপুল পরিমাণ মানুষ আর্থিক সহায়তাও পান তার কাছে।

ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সোমবার এই খবর প্রকাশ করেছে।

বদি এই কাজ শুরু করেন ২০১৬ সালে। অথচ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি তার বার্ষিক আয় উল্লেখ করেন ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠেছে, বদি তার আয়ের চেয়ে বেশি অর্থ কীভাবে বিতরণ করেন?

যেভাবে শুরু

২০১৬ সালে বদি তার নির্বাচনী এলাকায় দরিদ্র মানুষদের একটি তালিকা তৈরি করেন টেকনাফ পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে।

প্রত্যেককে একটি কার্ড দেওয়া হয় এবং তাদেরকে ১০ কেজি করে আতপ চাল বিতরণ শুরু হয় বলে জানিয়েছেন টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলম বাহাদূর।

বাহাদূর নিজেও এই কর্মকাণ্ডে একজন সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি জানান, টেকনাফ সদর ইউনিয়নে সাত হাজার হোয়াইকং ইউনিয়নে ১৩ হাজার, হ্নীলা ইউনিয়নে ১১ হাজার, বাহারছড়ায় নয় হাজার, সাবরাং ইউনিয়নে পাঁচ হাজার এবং শাহপরী দ্বীপেও কয়েক হাজার মানুষ তালিকাবদ্ধ হয়।

এই কার্ডে এক পাশে লেখা আছে, ‘বদি ভাইয়ের সালাম নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন। অন্য পাশে আছে বদির ছবি।

কক্সবাজার আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জাফর আলম চৌধুরীও নিশ্চিত করেছেন যে, ৫৬ হাজারের মতো মানুষ গত তিন বছর ধরে বিনামূল্যে চাল পেয়ে আসছে।

হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এইচ কে আনোয়ার তার ইউনিয়নে এই চাল বিতরণের বিষয়টি ঘোষণা করেন। অন্যান্য ইউনিয়নেও একই ঘটনা ঘটেছে।

পানখালি গ্রামের রেহানা আক্তার জানান, তিনি এই ঘোষণা শুনে কার্ড সংগ্রহ করে চাল সংগ্রহ করতে যান।

সাবারাং ইউনিয়নের রহিমা খাতুন বলেন, ‘গত তিন বছর ধরে চাল পেয়ে আসছি। এমপি সাহেব এর বিনিময়ে কিছু চাননি।’

যারা চাল পেয়ে আসছেন, তারা জানান, আপত চালের মান খুবই ভালো এবং এর দাম ২৮ থেকে ৩০ টাকা।

এই হিসাবে বদি মাসে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কেজি চাল বিতরণ করেন আর এর দাম হয় বছরে এক কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আর বছরে টাকার অংক দাঁড়ায় ১৯ কোটি টাকা।

এর বাইরেও স্থানীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতেও বদি একশ থেকে এক হাজার টাকার নোট বিতরণ করেন, যার কোনো হিসাব নেই। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে তিনি রাজনীতিক বা সাবেক আইন প্রণেতার চেয়ে দানবীর হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে উঠেছেন।

টেকনাফের সালামপুর হাইস্কুলের কাছে একটি চায়ের দোকানে বদির বিষয়ে কথা বলার সময় ৫৫ বছর বয়সী এক নারী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, ‘আপনি এখান থেকে ভাগেন। আপনার কোনো অধিকার নেই বদি ভাইকে নিয়ে কথা বলার। গত ৫০ বছরে তার মতো আর কেউ আমাদের উপকার করেনি।’

এই নারীর মতোই আরো পাঁচ থেকে ছয় জন একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানালেন।  

স্থানীয় রিকশা চালক মো. সামশুল বলেন, ‘বদি ভাইয়ের কাছে গিয়ে কেউ খালি হাতে ফেরে না।’

নুরুল আমিন নামে আরেকজন বলেন, ‘বদি ভাই আমাদেরকে প্রতি মাসে চাল বিতরণ করেন কিন্তু তার বিনিময়ে কিছুই চান না।’

বদি স্থানীয় একটি কলেজ, একটি হাইস্কুল এবং একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বদির বাবা এজাহার মিয়াও স্থানীয়ভাবে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তিনি সেই দলই করতেন। তিনিও টেকনাফ এজাহার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি বর্তমানে সরকারে স্কুল।

বদির আয় কতো?

গত মাসে চাল বিতরণের সময় বদি বলেন, ‘আমি আমার ব্যবসার ৭০ শতাংশ আয় মানুষের মধ্যে বিতরণ করি। এর সব কৃতিত্ব এলাকার মানুষের।’

তবে বদি তার ব্যবসার ধরণ আর তা কত বড় এবং তিনি কত টাকা দান করেন, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দেননি।

ডেইলি স্টার অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, বদি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সংসদ সদস্য হওয়ার পর আমদানি-রপ্তানির সেবা দানকারী সিএন্ডএফ এজেন্সি নিয়ন্ত্রণ করেন।

বদির নিজেরও চারটি এজেন্সি রয়েছে। এগুলো হলো: মেসার্স এ রহমান এজেন্সি (নিজের নামে), মেসার্স সামিয়া এন্টারপ্রাইজ (তার মেয়ের নামে), মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (ছেলের নামে) এবং মেসার্স শাহীন অ্যান্ড সন্স (পুত্রবধূর নামে)।

টেকনাফের চৌধুরীপাড়া এলাকায় একটি টিনশেড ভবনে এই চারটি এজেন্সির অফিস রয়েছে। এর সাইনবোর্ডে মালিক হিসেবে আবদুর রহমান বদির নাম উল্লেখ আছে।

সূত্র বলছে, এই চারটি এজেন্সির মাধ্যমে বদি মিয়ানমার থেকে মাছ, আচার, কাঠ, আদা আমদানি করেন আর সেখানে রপ্তানি করেন শুঁকটি মাছ। দেশটির সঙ্গে তার আত্মীয়তার বন্ধন রয়েছে। তার দাদা সুলতান আহমেদ মিয়ানমারে থাকতেন।

স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বদি মিয়ানমার থেকে বার্মাটিক সেগুনের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক আর এ থেকে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করেন। এটা তার আয়ের অন্যতম উৎস।

সাবেক আইনপ্রণেতা টেকনাফের একটি আবাসিক হোটেল এবং বেশ কিছু দোকানও প্রতিষ্ঠা করেছেন।

চারতলা নাফ হোটেল অবশ্য কয়েক বছরের মধ্যে পারিবারিক বাসভবনে পরিণত হয়। এর দুই থেকে তিনটি কক্ষ মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া দেওয়া হয়।

কক্সবাজার ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিসের সূত্র বরছে, বদি, তার স্ত্রী, বোন এবং ভাইদের নামে টেকনাফ, উখিয়া, ইনানী, বাহারছত্র এবং সেন্ট মার্টিনে বিপুল জমিরও মালিক।

গত কয়েক বছর ধরেই বদি কক্সবাজারের সর্বোচ্চ করদাতা বলে জানাচ্ছে জেলা আয়কর অফিস।

আলাদিনের চেরাগ

অভিযোগ আছে, বদি তার প্রকাশ্য ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা পাচারে জড়িত। আর তার সম্পদের একটি বড় অংশই আসে মিয়ানমার থেকে এই মাদক এনে। গত কয়েক বছর ধরে বহুবার এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমে।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্ত এবং বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বদিকে মাদকের গডফাদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে একাধিকবার।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইয়াবার অন্য বড় পাচারকারী বা স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বদির মতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই কাজ করতে পারবেন না।

এই প্রতিবেদন অনুযায়ী ইয়াবা পাচার বন্ধে বদির ইচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী বদির ভাই মুজিবুর রহমান ও আবদুল শুক্কুর এবং চাচাতো ভাই মং মং সেনও ইয়াবার গডফাদার।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজারে ইয়াবার ১২০ জন তালিকাভুক্ত পাচারকারী আছে। আর সবার আগে নাম আছে বদির।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ধারণা, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৪৬ কোটি ইয়াবার বড়ি পাচার হয়ে আসে। একেকটি বড়ি আড়াইশ টাকা করে বিক্রি হয়। এই হিসাবে এই কারবার অন্তত ১১ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার।

গত বছর পুলিশ, র‌্যাব, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবি এবং অন্যান্য সংস্থা মিলিয়ে তিন কোটি ৬৯ লাখ ইয়াবা বড়ি জব্দ করেছে।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিকবার দাবি করেছেন, তারা ইয়াবা কারবারে বদির সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য পাননি।

বদি নিজেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে আসছেন।

বদির ‘আয়ব্যয়ের হিসাব’

বদি বর্তমানে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য হলেও ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। পরে ২০০৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান।

ওই বছর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামায় বদি জানান, তিনি বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে বছরে এক লাখ ৭৬ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে ৯১ হাজার ৯৮ টাকা এবং ৩৩ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন লবণ মাঠ থেকে। অর্থাৎ তার বার্ষিক আয় তিন লাখ টাকার কম ছিল সে সময়। সে সময় তিনি জানান, তার ওপর নির্ভরশীলরা বছরে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা আয় করেন।

তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বদি জানান, তিনি কৃষি থেকে চার হাজার ৬৫০ টাকা, বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া থেকে দুই কোটি আট লাখ, ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি ৩২ লাখ, সঞ্চয়পত্র ও শেয়ার থেকে আট কোটি পাঁচ লাখ এবং লবণের মাঠ থেকে ৯১ হাজার টাকা আয় করেন বছরে।

এই হিসাবে তখন বদির বছরে আয় দাঁড়ায় ১৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা এবং তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় দাঁড়ায় তিন কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

এই আওয়ামী লীগ নেতা ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেননি। তার স্ত্রী শাহীন আক্তার পান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন।

হলফনামায় শাহীনা উল্লেখ করেন, তিনি কৃষি থেকে বছরে ১৮ হাজার ২৫৫ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে ৫৬ হাজার ৯৮০ টাকা, ব্যবসা থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা এবং লবণ মাঠ থেকে ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা আয় করেন। তিনি তার ওপর নির্ভরশীলদের আয়ের বিষয়টি উল্লেখ করেননি।

সম্পদের মিথ্যা তত্য বিতরণী দাখিলের দায়ে ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। সেই সঙ্গে তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

রায়ে জানানো হয়, বদি ২০১৩ সালের ৩০ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যে আয়করণ বিবরণী দাখিল করেন, তাতে তার মোট সম্পদ ছিল নয় কোটি ১৯ লাখ টাকা।

ওই বছরের ২ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় বদি জানান, তার সম্পদের পরিমাণ ১০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা।

তবে ২০১৪ সালের ২০ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দেওয়া হিসাবে জানান, তার সম্পদের পরিমাণ পাঁচ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। অর্থাৎ তিনি তার পাঁচ কোটি ৬৩ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর কারাগারে যাওয়া বদি উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।

বদির নতুন ভূমিকা

৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটের পর বদি তার এলাকায় ইয়বা কারবারে সম্পৃক্তদের আত্মসমর্পণের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছেন।  চলতি মাসের শেষের দিকে এটি হতে যাচ্ছে।

এরই মধ্যে ৬৩ জন সন্দেহভাজন ইয়াবা কারবারি ও গডফাদার এরই মধ্যে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে নিরাপত্তা হেফাজতে আছেন বলে তথ্য মিলেছে।

এদের মধ্যে বদির তিন ভাই আবদুল আমিন, মো. শফিক এবং ফয়সাল রহমানও আছেন। তারা সবাই জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ধরা দেন। এ জন্য তারা সম্প্রতি দুবাই থেকে দেশে ফিরেছেন।

গত ২৫ জানুয়ারি বদি বলেন, অনুরোধ করার পর তিনি তার স্বজনদের পাশাপাশি ইয়াবা কারবারে জড়িতদের আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করেছেন।