কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই অনৈতিকতার চর্চা

রহমান আজিজ
 | প্রকাশিত : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:০৬

দায়িত্ব থাকাকালে একটি বেসরকারি ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাকে নানা সুবিধা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সাবেক নির্বাহী পরিচালক অবসরের পর এখন সেই প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ছেলে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তহবিলের বড় অংকের টাকা ওই বেসরকারি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে।

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তদারকির দায়িত্ব এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু সেখানেও নানা ধরনের অনৈতিক অনুশীলনের কারণে এই তদারকি কার্যকরভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে।

একটি সাধারণ অনুশীলন হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অবসরে গিয়ে বেসরকারি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। আর তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন, তাদের সঙ্গে আগে থেকেই একটি সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন ওই কর্মকর্তারা। ফলে সেসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা অনৈতিক সুবিধা নিতে পারছেন।

আবার এই কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেও তারা যেহেতু এখানে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন, তাই সে প্রভাবকে কাজে লাগিয়েও নানা সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাকে বেসরকারি ব্যাংকে নিয়োগের কারণ একটাই। সেটা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তদবির।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এর জন্য একটি আইন করা উচিত। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য না সমগ্র সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য।’

‘চাকরি শেষে সরকারি কর্মকর্তারা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের কারণে স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি হয়। যেহেতু তাদের পরিচিতি আছে, সেহেতু সেখানে গিয়ে তারা অনাকাক্সিক্ষত সুবিধা আদায় করছেন।’

‘এক সময় নিয়ম ছিল, দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতে কেউ যোগদান করতে পারবে না। এই আইনটি হয়তো এখন বিদ্যমান নেই। অনেকেই এখন অবসর শেষে বেসরকারি খাতে যোগ দিচ্ছেন। আমি অতি দ্রুত সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ’

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসরে যাওয়া নির্বাহী পরিচালক মিজানুর রহমান জোয়ার্দ্দার অবসরে যাওয়ার এক মাস না যেতেই বেসরকারি পূবালী ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে সাবেক নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুমার ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। এরপর সুধীর চন্দ্র দাস ওয়ান ব্যাংকে এবং শুভঙ্কর সাহা কিউ ক্যাশ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠান আইটিসিএলের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন।

১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আতাউল হক যোগ দেন বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে।

আরও তিনজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর কাজ করেছেন ব্র্যাক, প্রাইম ও সাউথইস্ট ব্যাংকের উপদেষ্টা পদে। এরা হলেন নজরুল হুদা, জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী ও মুরশিদ কুলী খান।

আরেক সাবেক ডেপুটি গভর্নর মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ব্র্যাক ব্যাংক ও বিকাশের চেয়ারম্যানের দায়িত্বেও ছিলেন কিছুদিন।

সাবেক তিন মহাব্যবস্থাপক ও নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সায়খুল ইমাম, ইউসুফ আবেদী হারুণ ও মীর আবদুর রহিমের উত্তরা ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংকে তারা যোগ দেওয়ার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন।

আরও যেসব কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর নিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে উচ্চপদে কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক নির্বাহী পরিচালক ইয়াসিন আলী (প্রাইম ব্যাংক), সাবেক মহাব্যবস্থাপক অশোক বন্ধু দাস (বেসিক ব্যাংক), সাবেক মহাব্যবস্থাপক নিতাই দাস সাহা (ন্যাশনাল ব্যাংক), সাবেক নির্বাহী পরিচালক বি বি দেবনাথ (এবি ব্যাংক), সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবদুর রকিব (ইসলামী ব্যাংক), সাবেক নির্বাহী পরিচালক কাজী আনোয়ারুল মাহবুব (এসআইবিএল), সাবেক মহাব্যবস্থাপক রফিউল আলম (আল-আরাফাহ্ ব্যাংক)।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অবসরে গেলে কোথায় চাকরি করা যাবে বা কোথায় যাবে না, এ নিয়ে কোনো নীতিমালা না থাকায় এই অনৈতিকতার চর্চা চলছে। আর সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাদের নানা কর্মকা-ে বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছেন বর্তমান কর্মকর্তারাও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মহাব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকরি নেওয়ার পর সাবেকদের কেউ কেউ ছোটখাটো অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের কাছে আসেন। কখনো ফোন করেন। অনেক সময় তাদের এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আবার দায়িত্বে থাকাকালে যারা তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন, এখন তিনি তাদের ‘স্যার’ বলছেন; হয়তো বলছেন না। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা নয়। এজন্যই এটাকে একদিকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’; অন্যদিকে উভয় কর্মকর্তার জন্য বিব্রতকর বলে মনে হয়।’

ব্যতিক্রম শুভঙ্কর

তবে এর ব্যতিক্রম চিত্রও আছে। বিশেষ করে যারা উচ্চ নৈতিকতা চর্চা করেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসরে গেছেন এর মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমারও একাধিক ব্যাংক থেকে কাজের প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থায় ছিলাম বলে কোনো ব্যাংকে কাজ করতে রাজি হইনি।’

আইনি বাধ্যবাধকতার চিন্তা

শুভঙ্কর ইচ্ছা করেই অবসরে যাওয়ার পর অন্য প্রতিষ্ঠানে যোগ দেননি। তবে এই বিষয়টি এবার আইনি বাধ্যবাধকতায় আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকই নয়, দেশের সব নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার অবসরে যাওয়ার পর অন্তত দুই বছর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে চাকরি না করার বিধান রেখে একটি আইন করা হচ্ছে।

আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আইন কমিশন এ আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এর খসড়ার ওপর মতামত চাওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আইনটি পাস হলে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা অন্তত দুই বছর অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না। আমরা এমনই মতামত দিয়েছি। আইন কমিশন এটা নিয়ে কাজ করছে।’

আছে দুর্নীতির অভিযোগও

বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগও জমা পড়েছে। এতে বলা হয়েছে, রপ্তানি আয়ের বিপরীতে সরকারের নগদ সহায়তার অর্থ ছাড়, দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নানা সুবিধার বিনিময়ে অবসরে গিয়ে চাকরি পাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।

কোন কোন শীর্ষ কর্মকর্তা ব্যাংক সিলেকশন কমিশনকে নিয়োগের ব্যাপারে তদবির করছেন বলেও তথ্য মিলেছে।

ডেপুটি গভর্নর পদে পরীক্ষা দিয়ে মেধা তালিকায় শীর্ষ তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহিম। তার বিরুদ্ধে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে নানাবিধ অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়। দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরুও করে। আর দুদক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানানোর পর ডেপুটি গভর্নর নিয়োগের প্যানেলটি বাতিল করা হয়।

দুদক সূত্র জানায়, আবদুর রহিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ গ্রহণ, রপ্তানি আয়ের বিপরীতে সরকারের নগদ সহায়তার অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে অনিয়ম, কমিশনের বিনিময়ে ভুয়া ঋণ অনুমোদন ও বিতরণে সহায়তাসহ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে দুদকে জমা পড়া অভিযোগে বলা হয়, আবদুর রহিম রূপালী ব্যাংকের পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন নানা অনিয়ম করেন। তিনি বেআইনিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন ও ঋণ বিতরণে সহায়তা করেন।

অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম। ২০১৬ সালে ১৪ জুন অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আবদুর রহিমকে দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে জানান, আবদুর রহিমের ছেলে বেসরকারি সাউথইস্ট ব্যাংকে কর্মরত। আর সরকারি গৃহায়ন তহবিলের বড় একটি অর্থ এফডিআর হিসেবে সেই ব্যাংকে জমা করা হয়েছে গত মাসের প্রথম দিকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক প্রভাষ চন্দ্র মল্লিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ১১টি ব্যাংক থেকে ঋণ নেনে ৫৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৮৬ টাকা। এটি খেলাপি হয়ে কু-ঋণে পরিণত হয়। আর ব্যাংকগুলো ঋণের টাকা ফেরত চাইলে পরিশোধ না করে উল্টো সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের নানা হুমকি দেন বলেও অভিযোগ ছিল। এসব অভিযোগে ২০১৭ সালের ৯ অক্টোবর তাকে বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :