স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ বসুনিয়া স্মরণে

শফী আহমেদ
 | প্রকাশিত : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:১৬

১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আমার বন্ধু রাউফুন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের লেলিয়ে দেওয়া গুণ্ডাদের গুলিতে নিহত হন। এই দিনটি আমাদের জন্য একটি আবেগের দিন। ব্যক্তিগতভাবে আমার। কারণ, আমি কখনোই রাউফুন বসুনিয়ার উপরে লিখিনি। কারণ, একটা ঘটনাবহুল পরিবেশ এবং এরমধ্য দিয়ে মৃত্যু। সেই দিনের কথা বলতে গেলে আমার হাত থেমে যায়। কথা বলতে গেলে গলা বন্ধ হয়ে আসে।

তখন উপজেলা নির্বাচন ঘোষণা করেন এরশাদ। নির্বাচন ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের ভিত্তিটাকে তৃণমূল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৮৩ সাল থেকে ছাত্রসমাজের আন্দোলন চলছিল। ছাত্রসমাজ এই বিষয়টা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনকে প্রতিহত করার জন্য কোনো আন্দোলন দানা বাঁধছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরাও তেমন আন্দোলন করতে পারছিলাম না। কারণ, মিছিল বের করতে গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দিক থেকেই হামলা আসত। এমতাবস্থায়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাজের নেতৃবৃন্দ, তখন আমি জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, শহীদ মনিরুজ্জামান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, মাসুদ রানা সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক।

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এরশাদের পেটোয়া বাহিনী নতুন বাংলা ছাত্রসমাজকে উচ্ছেদ করব। সে লক্ষ্য নিয়ে অনেক পারস্পরিক আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের মধ্যে শঙ্কা ছিল যে, আমাদের মিছিলে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ মিছিলে হামলা করবে। তবুও আমাদের সামনে নতুন কোনো পথ খোলা ছিল না। আমরা মধুর ক্যান্টিনে এসে ঘোষণা দিলাম রাত্রে আমরা মিছিল সহকারে সূর্যসেন হলের গেটে সমবেত হওয়ার জন্য। একে একে মিছিল আসতে থাকল। মিছিলে এরশাদের পেটোয়া বাহিনীর একজন ছিল পাগলা শহীদ, তার নেতৃত্বে কয়েকটা ককটেল বিস্ফোরণ হয়। সূর্যসেন হলটাকে লাইট অফ করে অন্ধকার দিয়েছিল। তবুও মিছিল নিয়ে এগুচ্ছিলাম। তখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া ছিল।

মিছিলটি যখন স্যার এফ রহমান হল ও জহুরুল হক হলের মাঝামাঝিতে ছিল তখন কাল জ্যাকেট পরা, তখন হ্যালমেটের ব্যবহার ছিল না, কালো টুপি পরা মুখোশের মতো একটা মোটর সাইকেল এসে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং দুই রাউন্ড/ তিন রাউন্ড গুলি করে। আমরা বুঝতে পারিনি কী হয়েছে। এই গুলির পরে মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমরা যে যার আত্মরক্ষার জন্য মতো এগুচ্ছি। কিছুদূর এগুনোর পর সেই মুহূর্তে জাসদ ছাত্রলীগের মহসীন হলে সভাপতি কাজী জামিল হক রাজা। রাজা আমার বন্ধু । সে জানাল বসুনিয়ার মাথায় গুলি লেগেছে। মগজের মধ্যে গুলি লেগে তা আর বের হয়নি। তখন যারা ছিল তারা মিলে বন্ধু বসুনিয়ার দেহটা নিয়ে এগুতে থাকি। এখনও স্যার এফ রহমান হলের দিকে এলোপাতাড়ি গুলি চলতে থাকে। এসবের মধ্য দিয়েই আমরা বসুনিয়াকে মহসীন হলের দিকে নিয়ে আসি। তারপর পুলি আসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আসেন, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আসেন। যারা আসছিলেন তাদের মধ্যে ডা. মোস্তাকের নাম না বললেই নয়। তারপর পুলিশ প্রটেকশনে বসুনিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক বসুনিয়াকে নিয়ে মৃতু ঘোষণা করে।

এরপর সারারাত ধরে মহসীন হলকে রক্ষা করে নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও গুলি চালাতে থাকে। আমরা কোনো রকম আত্মরক্ষা করে চলতে থাকি। সকাল হলে বসুনিয়ার লাশ নিয়ে আমরা মিছিল নিয়ে বের হই। মিছিলটি যখন কার্জন হল অতিক্রম করে তখন সে মিছিলে পুলিশ গুলি ছুঁড়ে তখন মিছিল আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে পুরো ঢাকাজুড়েই বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ফলশ্রুতি এরশাদ উপজেলা নির্বাচনকে স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই রাউফুন বসুনিয়ার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এরশাদ একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো। তার দূরভিসন্ধিমূলক সিদ্ধান্ত স্থগিত ঘোষণা।

আজ বসুনিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীর সময় আর স্বৈরশাসক নেই। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে ৯০ সালে। কিন্তু রাজনীতির দেউলিয়াত্বের কারণে আজও সেই স্বৈরাচার এখনো ঝুলে আছে। স্বৈরাচারের রাজনৈতিক অবস্থান দেখে রাউফুন বসুনিয়ার কথা মনে হলে কিছু লিখতে ইচ্ছে করে না। রাউফুন বসুনিয়া, মেহেদী, মাসুদ রানা আমি আমরা খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম।

বাংলাদেশে দেখা যায় একজন মানুষের মৃত্যু হলেই তাকে নিয়ে গুণগান শুরু হয়ে যায়, কিন্তু বসুনিয়া আসলেই প্রকৃত সংগঠক ছিল। তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগ যতটা সংগঠিত ছিল তা সবকুটু অবদানেই ছিল বসুনিয়ার। জাতীয় ছাত্রলীগ ছিল বাকশালের অঙ্গ সংগঠন। আমরা যেহেতু তার বন্ধু ছিলাম তাই সে সবগুলো হলে রাউফুন বসুনিয়া জাতীয় ছাত্রলীগের কার্যক্রম চালানোর সুযোগ পেয়েছিল। একটা কথা বলতে চাই, আমরা যে যা কাজ করিছি। আমরা যে যে দলেরই সহযোগী বা অঙ্গসংগঠনের ছিলাম কেউ আমরা মূল দলের লেজুরবৃত্তি করিনি। আমরা নিজেই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। এমনকি আমাদের কেন্দ্রীয় সংসদও হস্তক্ষেপ করতো না। মধুর ক্যান্টিনে আমাদের অবস্থান ও কেন্দ্রীয় কমিটির অবস্থান এক জায়গায়ই ছিল তাই আমাদের মধ্যে কোনো দ্বিমত হয় নাই।

বসুনিয়া জীবন দিয়েছে গণতন্ত্রের জন্যে। রাউফুন বসুনিয়ার অর্থাৎ আমাদের সময়ের সেই কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র এখনো কায়েম হয় নাই। বাংলাদেশের যিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তিনিই পারেন বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে। তার কোনো বিকল্প নাই। তিনিই পারেন স্বৈরাচারী আন্দোলনে নূর হোসেন, জাফর জয়নাল, বসুনিয়া, মিলনসহ যারা শহীদ হয়েছেন তার সুষ্ঠু বিচার করতে। তিনি পারেন পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের পথে যে অন্তরায় আছে যে গ্যাপ আছে তা পরিপূর্ণ করতে। আর এতেই শহীদ বসুনিয়াদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

লেখক: স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতা, বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :