ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় এফবিসিসিআই

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৮:২৫ | আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৯:৪৩

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস

অসৎ ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন  ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। বলেছেন, নন পারফরমিং লোন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যারা অবৈধ পথে ব্যাংক লুটের উদ্দেশ্যে টাকা নিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হোক। কিন্তু যারা প্রকৃত ব্যবসা করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদেরকে এক্সিট রুট দেওয়া হোক।

রবিবার ঢাকা ক্লাবে এফবিসিসিআইয়ের অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপের সভাপতিদের সঙ্গে আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন তিনি। আসন্ন বাজেটের আগে সদস্যভূক্ত অ্যাসোসিয়েশনগুলোর ব্যবসায়িক সমস্যা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ শুনতে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনটি। বেলা ১১ টায় শুরু হওয়া এ সভা চলে বিকাল তিনটা পর্যন্ত। 

আলোচনার শুরুতে এফবিসিসিআইয়ের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও চলমান পাঁচটি প্রকল্প সদস্য সমিতিগুলোর কাছে তুলে ধরেন জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।

প্রকল্পগুলো হচ্ছে- টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ইকোনমিক পলিসি ইনস্টিটিউট, এফবিসিসিআইয়ের ব্যবসা বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্র, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিকুলাম অনুসরণ করে এফবিসিসিআই ইউনিভার্সিটি এবং পূর্বাচলে ৫৪ কাঠা জমিতে ৫০তলা ভবন নির্মাণ।

ব্যাংকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের পুনঃতফসিল দেওয়ার সুযোগ চেয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ৫০০ কোটি টাকার ওপরে যারা ঋণখেলাপি, তাদের ২০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য তা কেন চালু করা হয় না, আমরা জানতে চাই। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের হয়রানিমুক্ত ব্যবসা নিশ্চিত করা হোক। তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার পরিবেশ চাই। তাদের যেন রাস্তায় নেমে অধিকার আদায় করতে না হয়।’

সম্প্রতি গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমের উদ্যোগে অবকাঠামো নির্মাণে ১৬টি ছাড়পত্রের পরিবর্তে চারটিতে নামিয়ে আনার বিষয় তুলে ধরে শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘এই উদ্যোগে হয়রানি অনেক কমবে। বর্তমানে বন্দরে পণ্য খালাসে ১৪/১৫টি কাগজ লাগে। সিঙ্গাপুরে যেখানে চারটি কাগজ লাগে, আমাদের সেখানে ছয়টি লাগতে পারে। এদিকেও সংস্কারের দৃষ্টি দিতে হবে।’

সম্প্রতি সরকারের মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর স্থান পাওয়াকে দেশের জন্য ইতিবাচক উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘রাজনীতি ও অর্থনীতি একে অন্যের পরিপূরক। একজন ব্যবসায়ী রাজনীতিতে এলে তিনি সবচেয়ে বেশি সমাজসেবা করতে পারেন। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা ও ব্যবসায় সততা থাকতে হবে। দুই তিনজন অসাধু ব্যবসায়ীর জন্য গোটা ব্যবসায়ী সমাজ দায় নেবেন না। তাদের চিহ্নিত করতে এফবিসিসিআই সহায়তা করবে।’ 

বিগত দিনে দায়িত্বপালন করতে গিয়ে সহ সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম ও মুনতাকিম আশরাফের আকুন্ঠ সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ার কথা স্বীকার করেন মহিউদ্দিন।

‘গত দুই বছরে ফাহিম আমাকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন। আপনারাও তাকে সমর্থন দিয়ে তার পাশে ছিলেন। ভ্যাট ইস্যুতে আমরা প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেটা স্থগিত করাতে সক্ষম হয়েছি।’

সভায় বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের অন্তত ২০ জন প্রতিনিধি তাদের সমস্যা ও পরামর্শ তুলে ধরেন। তাদের অধিকাংশই আগামী দুই বছরের জন্য এফবিসিসিআই সভাপতি হিসাবে শেখ ফজলে ফাহিমকে সমর্থনের কথা জানান। এর আগে চেম্বার গ্রুপের মতবিনিময় সভায়ও নতুন সভাপতি হিসাবে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছিলেন ফাহিম। 

অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিদের সবাই ব্যাংকঋণে সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে এফবিসিসিআই নেতাদের পরামর্শ দেন।

ফিস ফার্ম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মোল্লা সামছুর রহমান শাহীন বলেন, ‘পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন ( পিকেএসএফ) কম সুদে এনজিওর মাধ্যমে শুধু এসএমই ঋণ বিতরণ করে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণের জন্য ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। অ্যাসোসিয়েশন সদস্যভূক্ত কোম্পানিগুলোকে কেন ঋণ দেওয়া হচ্ছে না।  আমরা এ ঋণ চাই।’

স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অ্যাসোসিয়েশনের আলী জামান বলেন, ‘যারা একবার ভ্যাট দিতে যান, তাদের কাছ থেকে বার বার আদায় করা হচ্ছে। যাদের ভ্যাট হয় না, তাদের কাছ থেকেও ভ্যাট আদায়ের চেষ্টা চলে। কিন্তু যারা ভ্যাট এড়িয়ে চলেন, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন না এনবিআর কর্মকর্তারা।’

‘ব্যাংক ঋণে সুদহার ৯ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ৯ শতাংশ ধরে অনেকে ব্যবসা শুরু করে এখন ক্ষতির মুখে পড়েছেন’- বলেন তিনি। 

জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘আমরা এ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করছি। আমরা ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনতে কাজ করছি।’

গত বছরের ১৪ এপ্রিল বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সঙ্গে বৈঠকে ঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে (সিঙ্গেল ডিজিট) নামিয়ে আনতে ব্যাংক মালিকদের তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ২০ জুন বৈঠক করে তা ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের এবিএম মাসুদ বলেন, ‘হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের পর এই শিল্প এখন বন্ধ হওয়ার পথে। বিদেশি ক্রেতারা সাভারের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সিইটিপি চালু হয়নি, ডাম্পিং স্টেশনও চালু হয়নি।’

‘আমাদের বলা হয়েছিল, সাভারে পরিবেশসম্মত গ্রিন ইন্ডাস্ট্রিজ করে দেওয়া হবে। তার কিছুই হয়নি। সিইটিপির জন্য আটবার সময় বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনও সেটা অচল। এই ইন্ডাস্ট্রিজ এখন গলার কাটা হয়েছে।’

সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা সব ঋণখেলাপিদের কাছে চলে গেছে। ফলে ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যাংকে টাকা চাইলে তারা দিতে পারছে না।’

ভোজ্যতেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হাজি গোলাম মাওলা বলেন, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে ব্যবসায়ীদের প্রায়ই সমালোচনা করা হয়। কিন্তু এই পণ্য নিয়ে কোনো মনিটরিং নেই। প্রতি দুই মাস পর পর ভোজ্যতেলের বাজার মনিটর করে সে অনুযায়ী সুপারিশ তৈরি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বাংলাদেশ পুস্তক বাঁধাই ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, এনসিটিবি টেন্ডারে এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেয়, যাতে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন না।  এই চক্রকে ভাঙতে টেন্ডারের নীতি শিথিল করতে হবে।

এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ, চিনি ব্যবসায়ী সমিতির আবুল হাশেম, স্টিল মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মো. শাহজাহান, পাথর ব্যবসায়ী হাজি আব্দুল আহাদ, এয়ারকন্ডিশন আমদানিকারক লুৎফুর রহমান, ক্রোকারিজ অ্যাসোসিয়েশনের মনির হোসেন, ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির ইসমাইল হোসেন, অ্যাম্রেলা ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যাসোসিয়েশনের হাফিজ আল আসাদ, কালি প্রস্তুত সমিতির এস এ মোমেন, রফিকুল ইসলাম মাসুদ,  সরদার মোহাম্মদ সালাউদ্দিন আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন। বিজিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমানসহ বিভিন্ন সÍরের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।

(ঢাকাটাইমস/১৭ফেব্রুয়ারি/জেআর/এআর)