হৃদয় ভরে নাও বসন্তের ভালোবাসা

প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:৩২

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

আমাদের স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন একটা লম্বা শিমুল গাছের সঙ্গে দেখা হতো। গাছটা ছিল বিলের ধারে। দেখে মনে হতো, আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছায় প্রতিদিন সে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। একটা সময় গাছটায় আগুন লেগে থাকত। কী টকটকে লাল! কী লোহিত শোভা! রোদের আলোয় ঠিকরে পড়তো রূপ। তখন তো আর বুঝতাম না, কী ফাগুন, কী বসন্ত।

তবে গাছে আগুন লাগা ওই দিনগুলোতে স্কুলে যেতে প্রতিদিন দেরি হয়ে যেত। কারণ বিলের ধারে এলেই উবু হয়ে বসে পড়তাম ফুল কুড়াতে। স্কুলব্যাগটা তখন লেপ্টে থাকত পিঠে। শিমুলের মোহে কখন যে সময় বয়ে যেত, বুঝতে পারতাম না। আমার চোখে তখন রাজ্যের বিস্ময়! এত এত ফুল! মন বলে সবটাই তুলে নিই। ফুল কুড়িয়ে যখন দু হাত ভরে যেত, ব্যাগ খুলে তুলে নিতেম তাতে। প্যান্টের পকেটেও নিতেম কিছু।

অনেক সময় শিমুলের রং লেগে যেত বইয়ের পাতায়। সাদা খাতায়। আস্তে আস্তে কালচে হয়ে আসত। শুধু অটুট থাকত মনের পাতায় লাগা রং।

স্কুলে গিয়ে একটা একটা বের করে বন্ধুদের হাতে দিলে কী যে খুশি হতো! আমার সঙ্গে তখন সহপাঠীদের কী যে সখ্য! কী বন্ধন! ফাগুনের সেই সখ্যে এগিয়ে ছিল মেয়েরা। হাত পেতে থাকত। একটা দুটো ফুলে তাদের হতো না। মালা গাঁথবে। দুটো মালা হলে একটা আমাকে দেবে। সেই লোভে ব্যাগ আর পকেট খালি করে ভরে দিতেম তাদের হাত। এখনো আমার কাছে কতজনার মালার ঋণ!

পরদিন আবারও বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে পৌঁছে যেতাম বিলের ধারে। লাল হয়ে থাকা শিমুলতলা। ফুলে ফুলে পথটা এমন হতো যে, ওখানটার মাটির রং-ই বদলে যেত। তখনো শীত যাই যাই করছে। ভোরের কুয়াশায় অমলিন থাকত ঝরা ফুলও। রোদ পড়ে চকচক করত ফুলের ওপর পরে থাকা শিশির বিন্দু। যেন হিরেচূর্ণ ছড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। 

কুড়ানোর সময়ও দু-একটা ফুল ঝরে পড়ত ইতিউতি। মনে হতো, শিমুল গাছটা আমায় দেখছে। আপনা থেকেই দু-একটা ফুল বিলিয়ে দিয়ে বলছে, ‘নাও, তুলে নাও। দু হাত ভরে তুলে নাও। আরও চাও তো আরও দেবো।’

সন্ধ্যায় শিমুল গাছটাকে বড় অদ্ভুত মনে হতো। আকাশের মতো বদলে যেত তার রং। পশ্চিমের আকাশে সূর্যটা দেখাত ডিমের কুসুমের মতো। সেই আভায় হলদে শাড়ি পরত শিমুল। কী মাতাল করা রূপ তার অঙ্গে!

বিলের পুবে ছিল খেলার মাঠ। সেখান থেকে তাকালে বড় অচেনা মনে হতো চিরচেনা বন্ধুÑ শিমুল গাছ। চারপাশের গাছ-বৃক্ষির ঘন পত্র-পল্লবও ম্লান হতো সেই শোভায়। দু-একটা শালিক, বুলবুলি থাকে থাকে মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকাত। মনে মনে ভাবতাম, পাখিদের কী সুখ! ফুলের সঙ্গে কী গহন ভালোবাসাই না তাদের!

সেই অচেনা গাছের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গলাগলি ধরে বাড়ি ফিরতাম। আমাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরত পাখিরাও। সূর্য ডুবে গেলেও আকাশে তখনো আলো থাকত। সে আলোয় সব পাখি দেখতে একই রকম লাগত। কালো কালো ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। দু-একটি দলছুট পাখিও আছে, বন্ধুদের মতো। আমাদের পিছু পিছু যারা একা একা হেঁটে আসত।

শৈশবের সেই বসন্তদিন আমায় এখনো ডাক পাঠায়। কাছে ডাকে। ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই বিলের ধারে। লাল হয়ে থাকা শিমুল তলায়। শুনেছি পুবের সেই মাঠটা এখন আর তেমনটি নেই। বিলের আধেকটাও ভরে গেছে। সেখানে উঁকি দিচ্ছে ইটপাথরের সভ্যতা। কিন্তু বুড়ো শিমুল গাছটা আছে। ওই পথে এখনো অনেক কিশোর স্কুলব্যাগ কাঁধে হেঁটে যায়। হয়তো তারাও দাঁড়ায়। দু হাত ভরে ফুল তুলে নেয়। চাইলেই কি ফিরিয়ে দেওয়া যায় শিমুলের ভালোবাসা?

এখনো শিমুল গাছ দেখলে থমকে দাঁড়াই। ব্যাগ বা জেব ভরে নিতে না পারলেও হাত ভরে তুলে নেই লালের ভালোবাসা। তখন দু-একটা ফুল ঝরে পড়তে দেখলে মনে হয়ে যায় সেই স্কুল পথের শিমুল গাছটার কথা। মনে হয়, এই তো সেই, আমার শৈশবের শিমুল-বন্ধু। হাসিমুখে বিলিয়ে দিচ্ছে ফুল। বলছে, ‘দু হাত ভরে নাও বন্ধু। হৃদয় ভরে নাও বসন্তের ভালোবাসা।’

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ: গল্পকার ও সাংবাদিক