চুনারুঘাটে সাব-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে অভিযোগ

চা-শ্রমিককে বিক্রেতা সাজিয়ে কোটি টাকার জমির দলিল

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ০৮:১৭

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস

দুই চা-শ্রমিককে বিক্রেতা সাজিয়ে দলিল সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি টাকার সম্পত্তি আত্মসাতে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রারসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করেছেন ওই দুই চা-শ্রমিক।

এ ঘটনায় চুনারুঘাটে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সিন্ডিকেটের কাছ থেকে বড় অঙ্কের উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ উঠলেও সাব-রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশ দাবি করেন, প্রভাবশালী একজন রাজনৈতিক নেতার চাপে ওই দলিল সম্পাদন করেন তিনি।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চুনারুঘাটের দেওরগাছ মৌজার ১১৯ নং এসএ খতিয়ানের ১০৭৪ এসএ দাগের ২.৬৪ একর ভূমির এসএ রেকর্ডীয় মালিক ছিলেন দেওরগাছ ইউনিয়নের আমকান্দি গ্রামের মহেশপালের ছেলে হেমন্ত পাল এবং দেবেন্দ্র পালের ছেলে দীগেন্দ্র পাল। এসএ রেকর্ডের মালিকরা ওই জমি ১৯৫৬ সালে ৭৪০ নং দলিলে বিক্রি করেন ওই এলাকার মুনছর আহম্মদের কাছে। এসএ রেকর্ডে হেমন্ত পালদের পদবিতে ভুলে দাস লেখা হয়। চলমান আরএস জরিপে বিষয়টি নজরে আসে এলাকার একটি ভূমি খেকো চক্রের। তারা সেটেলমেন্ট কর্মকর্তার মাধ্যমে ওই জায়গার বর্তমান মালিক ইব্রাহিম কবির গংদের নাম না দিয়ে এসএ রেকর্ডিয় মালিক হেমন্ত পালদের নাম রেখে দেয়। কিন্তু ‘পাল’ না লিখে সেখানেও ‘দাস’ উল্লেখ করা হয়। অথচ আমকান্দি গ্রামে কোনো সময় দাস সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস ছিল না।

ইব্রাহিম কবির গং বিষয়টি জানতে পেরে মামলা করলে আদালত ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট ওই জমির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয়। ৫ সেপ্টেম্বর ইব্রাহিম কবির ওই জমি অবৈধ ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রি না করতে সাব-রেজিস্ট্রার বরাবর আবেদন করেন। ফলে তখনকার সাব-রেজিস্ট্রার ওই জায়গার কোনো দলিল সম্পাদন করেননি।

এদিকে চুনারুঘাটের একটি প্রভাবশালী চক্র রাজনৈতিক নেতার চত্রছায়ায় ভুয়া বিক্রেতা সাজিয়ে দলিল করার চেষ্টা করে। সম্প্রতি এ ব্যাপারে দুটি দলিল দাখিল করা হলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবং বিষয়টি জানতে পেরে সাবেক সাব-রেজিস্ট্রার শংকর কুমার ধর দলিল দুটি জব্দ করেন।

কিন্তু নিতেন্দ্র লাল দাশ নতুন সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করলে চক্রটি আবার সক্রিয় হয়। তারা গেলানী ও লস্করপুর চা-বাগানের দুই শ্রমিককে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি ভাতা দেবে আশ্বাস দিয়ে সিলেটে নিয়ে যায়। সেখানে গেলানী চা-বাগানের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক বাসুদেব মুড়াকে দিগেন্দ্র চন্দ্র দাস এবং লস্করপুর চা-বাগানের শ্রমিক নিপেন বাকতিকে হেমেন্দ্র চন্দ্র দাস নাম দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বানায়।

পরে গত ১৭ জানুয়ারি মো. আশরাফ আলীসহ তার পক্ষের ১২ জনের নামে ২৪০ নং দলিল সম্পাদন করে দেন তারা। এতে জমির বিক্রয়মূল্য দেখানো হয় ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। দলিল সম্পাদন করার পর সাব-রেজিস্ট্রার তা গোপন রাখেন।

বিষয়টি জানতে পেরে ইব্রাহিম কবির অফিসে যোগাযোগ করলে তাকে কোনো নকল দেয়া হয়নি এবং এ ধরনের দলিলের কথা জানানো হয়নি। ক্রেতা আশরাফ আলী গং ওই দলিলের নকল নিয়ে নামজারি করতে গেলে ইব্রাহিম কবির বাধা দেন এবং উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমির কাছে আবেদন করলে নামজারির আবেদন খারিজ করা হয়।

দুই চা-শ্রমিক দলিল সম্পাদন করার পরও যখন তাদের নামে কোনো ভাতার ব্যবস্থা হয়নি তখন খোঁজ নিয়ে বুঝতে পারে তারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তখন তারা নোটারি পাবলিকের কাছে হলফনামা করে নিজেরা প্রতারিত হয়ে নাম পরিবর্তন করে ভুয়া বিক্রেতা হিসেবে দলিল সম্পাদন করেছেন বলে ঘোষণা দেন। এরপর তারা হবিগঞ্জ দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবর সাব-রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

চা-শ্রমিক বাসুদেব মুড়া ও নিপেন বাকতি জানান, তারা লেখাপড়া তেমন জানেন না। চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। সরকারি অনুদান পাওয়া সহজ হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে অভিযুক্তরা তাদের নতুন আইডি কার্ড তৈরি করান। পরে চানপুর গ্রামে আশরাফ আলীর বাড়িতে রাতের বেলা সাব-রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশ অফিস সহকারী কবির চৌধুরীকে নিয়ে জোরপূর্বক রেজিস্টারি স্ট্যাম্পে দস্তখত নেন। পরে জানতে পেরে হলফনামা প্রদান করেন তারা।

জমির মালিক ইব্রাহিম কবির বলেন, ‘আমার পিতা এই জমি এসএ রেকর্ডীয় মালিকের কাছ থেকে কেনার পর নির্বিবাদে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ভোগদখল করে আসছি। বিক্রেতার নামে পালের জায়গায় দাস থাকায় একটি প্রভাবশালী চক্র এই জমি আত্মসাতের চেষ্টা করলে আমি আদালতের আশ্রয় নিই। আদালত নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও সাব রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশ উৎকোচ নিয়ে ভুয়া দলিল সম্পাদন করেছেন।’

এ ব্যাপারে জানতে ক্রেতা আশরাফ আলীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ক্রেতা মাহফুজ মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ফোন ধরেননি।

সাব-রেজিস্ট্রার নিতেন্দ্র লাল দাশ উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও ইব্রাহিম কবিরের আবেদনের বিষয়টি তার জানা নেই। তবে তিনি স্বীকার করেন একজন রাজনৈতিক নেতার চাপে ওই দলিল সম্পাদন করতে বাধ্য হন তিনি। তবে নেতার নাম বলেননি তিনি।

এ ব্যাপারে দুদকের হবিগঞ্জের উপপরিচালক অজয় কুমার সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিলেটে আছেন জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।

(ঢাকাটাইমস/২০ফেব্রুয়ারি/মোআ)