চুড়িহাট্টা বিস্ফোরণের প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা

প্রকাশ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪৪ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:২২

কাজী রফিক, চকবাজার থেকে

কিছুটা দূর থেকে পোড়া গণ্ধ নাকে লাগে। আরো সামনে এগিয়ে যেতে চোখের সামনে হঠাৎ বদলে যায় পরিবেশ। এক বিধ্বস্ত নগরীতে যেন এসে পড়ি। হলিউডি চলচ্চিত্রে দেখা যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর যেন। রাস্তায় যানবাহনের পোড়া কাঠামো- প্রাইভেটকার, পিকআপ, মোটরসাইকেল, রিকশা, ভ্যান। পাশেই পুড়ে যাওয়া গ্যাসের সিলিন্ডার। স্তূপ হয়ে আছে আরও কত জিনিসপত্র! দুই পাশের ভবন বিধ্বস্ত। শার্টার পুড়ে বাঁকা হয়ে ঝুলছে। দরজা-জানালা কোথায় ওড়ে গেছে। দেয়াল পুড়ে কালচে হয়ে আছে।

পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টা চৌরাস্তার এ দৃশ্যপট দেখে যে কারও মনে হতে পারে, এখানে কিছু আগেও বুঝি সচল জীবন ছিল। হঠাৎ কোনো শক্তিশালী বোমায় মুহূর্তে ঝলসে গেছে সব।

আসলে তা-ই। বুধবার রাত দশটার দিকে প্রতিদিনের মতো ব্যস্ত ছিল জায়গাটি। আরও পরিষ্কার করে বললে, তখন সেখানে গাড়িঘোড়ার জট লেগে ছিল। তাতে ছিল নানা বয়সী যাত্রী। ছিল পথচারী। দুই পাশের ভবনের বিভিন্ন হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করছিল ক্ষুধার্ত মানুষ। দোকানে দোকানে ক্রেতা আর দোকানি ব্যস্ত ছিল শেষ সময়ের কেনাবেচায়। গাড়ির হরন আর রিকশার টুংটাং শব্দে প্রাণময় জায়গাটি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় বিকট শব্দে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারপাশে দাউ দাউ আগুনে ঢেকে যায়। আশপাশে তখন মানুষের ছোটাছুটি, হইচই পড়ে যায়। আর আগুনের ভেতরে জীবনের সাড়াশব্দ কমে আসে। ক্ষণে ক্ষণে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে সিলিন্ডার কিংবা অন্য কোনো রাসায়নিক কৌটা।

এমনই এক বীভৎস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে মানুষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বিস্ফোরণের পাশাপাশি ছড়াতে থাকে আগুন।

ধ্বংসযজ্ঞের শুরুর এই বর্ণনাটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ আহমেদের। স্থানীয় ব্যবসায়ী রশিদ জানান, জ্যামে আটকে থাকা একটি পিকআপের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে এই ভয়াবহ নরককাণ্ডের সূত্রপাত। এরপর একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। তবে প্রথম বিস্ফোরণের পরই ওই পথে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। আর তাতে রাস্তায় যানবাহনে আটকে থাকা মানুষ ও পথচারীরা দগ্ধ হন আগুনে।

রশিদের ভাষ্য, প্রথম বিস্ফোরণের পর আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়ে পাশের হাজি ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার খাবার হোটেলে। হোটেলের সামনে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারেও বিস্ফোরণ ঘটে তখন। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনে।

আগুনের সূত্রপাত নিয়ে আরও অনেকের ভিন্ন তথ্য রয়েছে। কারও ভাষ্য, পাশের ভবনের বডি স্প্রের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত। কেউ কেউ বলছেন, বিদ্যুতের ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের কথা। অনেকে রেস্তোরাঁর সিলিন্ডারের কথাও বলেন।

প্রত্যক্ষদর্শী রশিদ বলেন, ‘এগুলো ভুল তথ্য। আমি পাশের এটিএম বুথের সামনে ছিলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি। গাড়ির সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে শুরু। এরপর হোটেলে। এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর গুদামে বিস্ফোরণ হয়।

ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসতে আসতে ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে গেছে। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে অগ্নিনির্বাপন সংস্থাটির কর্মীরা রাস্তা থেকেই অনেকের পোড়া দেহ উদ্ধার করেন।

ফায়ার সার্ভিসের সর্বশেষ তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত মোট ৮১ জনের মৃত্যুর খবর জানা যাচ্ছে। আহত হয়েছে আরও অনেকে। তবে ঘটনার ১৮ ঘন্টা পর এখনো নিখোঁজ অনেকে। হাসপাতাল ও ঘটনাস্থলের আশপাশে স্বজনদের ভিড়। তাদের আহাজারিতে এক বেদনাবিধূর পরিবেশ।

চুড়িহাট্টা মোড়ে মুদির দোকানে কাজ করত ১৮ বছর বয়সী মো. পারভেজ।  ঘটনার বর্ণনা দিয়ে পারভেজের বাবা মো. আলমগীর ঢাকা টাইমসকে বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ১০ মিনিট আগে ছেলেকে বাসায় খাওয়ার জন্য পাঠান। আগুনের সময় নিজে দোকানের ভেতরের দিকে থাকা পানির টাংকিতে আশ্রয় নেন।  আগুন  নিভে যাওয়ার পর তিনি অক্ষত বের হয়ে আসেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকে ছেলে পারভেজ নিখোঁজ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও মিডফোর্ট হাসপাতালে একাধিকবার খুঁজেও তাকে পাননি।

চুড়িহাট্টা মোড় দিয়ে রিকশা করে দোকানে যাচ্ছিলেন কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা এনামুল হোসেন। তাসফিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক এনামুলের সঙ্গে ছিলেন তার দোকানের কর্মচারী তুষার। হঠাৎ বিস্ফোরণের পর যে যার মতো ছুট দেন। ১৮ বছর বয়সী তুষার প্রাণ বাঁচাতে পারলেও ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ এনামুল হোসেন।

তুষার বলেন, ‘যহন বিস্ফোরণ হয়, তহন যে যার মতো দৌড় দিছে। হ্যায় (এনামুল হোসেন) একদিক গেছে, আমি একদিক গেছি। এহন আর হ্যারে খুইজা পাওয়া যাইতাছে না।’

বাবার ছবি হাতে বিধ্বস্ত চুড়িহাট্টায় এসেছেন মেয়ে নাসরিন আক্তার। মুখে বাবার জন্য আকুতি, চোখে জল। বাবার বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছেন, রাত সাড়ে দশটা নাগাদ তিনি এই এলাকায় ছিলেন। ঘটনার পর থেকে তিনি বাসায় ফেরেননি। বাবাকে খুঁজতে আশপাশের সব হাসপাতালে খোঁজ-খবর নিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ বাবার ছবি হাতে ঘুরে ফিরছেন চুড়িহাট্টার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে।

নিখোঁজ জয়নাল আবেদিন বাবু  চুড়িহাট্টার পাশে ২৬ আজগর লেনের বাসিন্দা। আগুনের ঘটনায় ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর তাকে খুঁজতে এসেছেন শিরিন আক্তার। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে  আলাপকালে তিনি পুরান ঢাকা থেকে সব কেমিক্যাল  কারখানা ও গুদাম সরিয়ে নেয়ার দাবি করেন।  বলেন, ‘কেমিক্যাল না থাকলে আগুন এত বাড়ত না।  এত ক্ষতিও হইত না।‘

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আগুনের ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করতে কাজ করছে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। সংগঠনটির  ফিল্ড অফিসার মাহবুবুল হক ঢাকাটাইমসকে জানান, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তারা স্বজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করছেন। এখন পর্যন্ত তাদের কাছে ২৫ জন নিখোঁজের তথ্য এসেছে।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি/মোআ)